আলঝেইমার ডিজিজ কী? এই রোগ চেনার উপায় ও প্রতিকার
আলঝেইমার ডিজিজ একটি জটিল এবং প্রগতিশীল রোগ যা ব্যক্তির জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এই রোগ বিশ্বব্যাপী খুবই দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক সময় এই রোগ প্রবীণ ব্যক্তিদের মধ্যে দেখা যেতো, কিন্তু আজকাল এটি মধ্য বয়সীদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে। গত আলোচনায় আলঝেইমার ডিজিজের কারণ এবং এর প্রকারভেদ সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম। আজকে আমরা জানবো এই রোগের লক্ষণ এবং প্রতিকার সম্পর্কে।
আলঝেইমার ডিজিজ কী?
আলঝেইমার ডিজিজ (Alzheimer's Disease) একটি প্রগতিশীল স্নায়বিক ব্যাধি যা মস্তিষ্কের কোষগুলির ধীরে ধীরে ক্ষতি করে এবং স্মৃতিশক্তি, চিন্তাশক্তি, এবং আচরণের ক্ষমতা হ্রাস করে। এটি ডিমেনশিয়ার সবচেয়ে সাধারণ কারণগুলির মধ্যে একটি, যা ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্মে প্রভাব ফেলে। আলঝেইমার ডিজিজের জেনেটিক কারণগুলি ব্যাপক ও জটিল। কিছু নির্দিষ্ট জিনের মিউটেশন এই রোগের ঝুঁকি বাড়ায়, তবে জীববিজ্ঞান ও পরিবেশগত ফ্যাক্টরগুলিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই রোগের ঝুঁকিতে বয়স একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এটি এককভাবে রোগের কারণ নয়। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে অন্যান্য জেনেটিক, পরিবেশগত, এবং জীবনধারার কারণগুলিও আলঝেইমারের ঝুঁকি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।
আলঝেইমার ডিজিজের লক্ষণসমূহ:
আলঝেইমার ডিজিজের লক্ষণসমূহ ধীরে ধীরে শুরু হয় এবং সময়ের সাথে সাথে আরও খারাপ হতে থাকে। এই লক্ষণগুলো স্মৃতি, চিন্তা, আচরণ, এবং দৈনন্দিন জীবনের কার্যক্রমে প্রভাব ফেলে। এই রোগের প্রধান লক্ষণগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
১. স্মৃতিভ্রংশ
• স্মৃতিভ্রংশ আলঝেইমারের সবচেয়ে সাধারণ এবং প্রথম লক্ষণগুলোর একটি। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগী সাম্প্রতিক তথ্য ভুলে যায় এবং রোগীকে বারবার একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে দেখা যায়।
• দৈনন্দিন কাজকর্ম বা কথোপকথনের সময় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ভুলে যাওয়া বা সাম্প্রতিক ঘটনা মনে করতে না পারা এই রোগের প্রাথমিক ও সাধারণ লক্ষণ। রোগী বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তার জীবনের ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনা ভুলে যায়। এমনকি সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া কোনও ঘটনাও মনে করতে পারে না।
২. সমস্যা সমাধানে অসুবিধা
• গাণিতিক হিসাব করা বা দৈনন্দিন কাজের পরিকল্পনা করা কঠিন হয়ে পড়ে এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে। হিসাব করার সময় সাধারণ হিসাব করতে না পারা কিংবা ভুল করা এই রোগের প্রাথমিক লক্ষণ।
• রান্না করা বা বিল পরিশোধের মতো নিয়মিত কাজগুলোও সম্পন্ন করতে সমস্যা দেখা দেয়। অনেক সময় রান্না করতে গিয়ে কোনও উপকরণ দিতে ভুলে যাওয়া বা একই উপকরণ একাধিক বার দেয়া এই রোগের প্রাথমিক কারণ।
৩. পরিচিত কাজকর্ম করতে অসুবিধা
• প্রতিদিনের সাধারণ কাজ, যেমন গাড়ি চালানো, রান্না করা, বা পরিচিত কোনো স্থানে যাওয়া এই ধরনের রোগীদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। তারা গাড়ি চালাতে গিয়ে সাধারণত পথ ভুল করে বসে। এমনকি তার চেনা কোনও জায়গায় গিয়েও চিনতে পারে না, কিংবা চেনা কোনও জায়গায় যাওয়ার পথ ভুলে যেতে থাকে।
• কাজকর্ম সম্পন্ন করতে বেশি সময় লাগে এবং একবার শুরু করলে সম্পূর্ণ করতে সমস্যা হয়। সাধারণত একটি কাজ বারবার করা কিংবা কাজ করার বিষয়বস্তু ভুলে যাওয়া খুবই সাধারণ সমস্যা এই ধরনের রোগীদের জন্য।
৪. সময় এবং স্থান সম্পর্কে বিভ্রান্তি
• তারিখ, ঋতু বা সময়ের ধারণা হারিয়ে ফেলা আলঝেইমারের একটি সাধারণ লক্ষণ। এই ধরনের রোগীরা আজ কি বার, কত তারিখ বা এটি কত সাল সেটি দ্রুত মনে করতে পারে না। আবার কারও নিকট থেকে শোনার কয়েক মিনিট পর সেটি আবার ভুলে যায়।
• তারা কোথায় আছেন বা কীভাবে সেখানে পৌঁছেছেন তা ভুলে যেতে পারেন। এই ধরনের রোগীরা ঘরের বাইরে কোথায় গেলে কোথায় গেছেন বা কি করে গেলেন সেটি দ্রুত ভুলে যায়।
৫. দৃষ্টিশক্তি এবং স্থানিক সম্পর্কের সমস্যা
• আলঝেইমার রোগীরা দৃষ্টিশক্তির সমস্যা এবং জিনিসের দূরত্ব বা গভীরতার ধারণা নিয়ে বিভ্রান্ত হতে পারেন। তারা দ্রুত কোনও কিছুর দুরত্ব বা গভীরতা পরিমাপ করতে পারে না।
• ড্রাইভিং বা চলাফেরার সময় জিনিসের সাথে ধাক্কা লাগা বা পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
৬. শব্দের সন্ধানে অসুবিধা
• কথোপকথনের সময় সঠিক শব্দ খুঁজে পেতে বা বাক্য গঠন করতে সমস্যা হয়। তারা অনেক সময় অসংলগ্ন কথা বলতে থাকে, শব্দ খুঁজে না পেয়ে তোতলাতে থাকে।
• প্রায়শই কথোপকথনের মধ্যে থেমে যেতে হয় এবং কীভাবে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে হবে তা বুঝতে অসুবিধা হয়।
৭. জিনিসপত্র হারিয়ে ফেলা এবং খুঁজে বের করতে না পারা
• জিনিসপত্র ভুল জায়গায় রেখে দেওয়া এবং খুঁজে না পাওয়া আলঝেইমারের একটি সাধারণ লক্ষণ। জিনিসপত্র রাখার সময় খুবই সচেতন ভাবে রাখে কিন্তু খোঁজার সময় আর খুঁজে পায়না।
• কিছু রেখে কোথায় রেখেছেন তা মনে করতে পারেন না এবং এই কারণে অন্যকে চুরির জন্য দোষারোপ করতে পারেন।
৮. খারাপ সিদ্ধান্ত এবং বিচারের ক্ষমতা কমে যাওয়া
• টাকা খরচ বা বিনিয়োগের বিষয়ে খারাপ সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং সঠিক বিচার না করতে পারা এই রোগের অন্যতম লক্ষণ। অনেক সময় ভুল সীদ্ধান্ত নিয়ে বিপদে পড়ে এবং ব্যবসায় মারাত্নক ক্ষতির মধ্যে পড়ে।
• ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য এবং পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে অবহেলা করে আলঝেইমার ডিজিজে আক্রান্ত রোগীরা। তারা শরীরের ব্যাপারে থাকে উদাসীন।
৯. সামাজিক এবং কাজকর্ম থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করা
• প্রিয় শখ, সামাজিক কার্যক্রম, বা কাজ থেকে দূরে থাকা শুরু করে আলঝেইমার ডিজিজে আক্রান্ত রোগীরা। ভুলে যাওয়ার ভয়ে তারা একা থাকা পছন্দ করে। অনেক সময় তারা তাদের প্রিয় শখ বা প্রিয় মানুষদেরও ভুলে যেতে পারে।
• পরিবারের সদস্য বা বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দেয় এবং সামাজিক একাকীত্ব বোধ করে।
১০. মেজাজ এবং ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন
• অবসাদ, উদ্বেগ, বিভ্রান্তি, এবং সন্দেহবোধ দেখা যায়, বিশেষ করে পরিচিত স্থানের বাইরে থাকলে। তাদের ব্যক্তিত্বে দ্রুত পরিবর্তন দেখা দেয় এবং তারা অবসাদে ভোগে।
• রোগী অস্বাভাবিকভাবে রেগে যেতে পারে, হতাশা বা উদ্বেগ অনুভব করতে পারে, এবং আচরণে হঠাৎ পরিবর্তন দেখা দিতে পারে।
আলঝেইমার ডিজিজ প্রতিরোধের উপায়:
আলঝেইমার ডিজিজের প্রতিরোধ সম্পূর্ণরূপে সম্ভব নয়, তবে কিছু জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং স্বাস্থ্যকর অভ্যাস অনুসরণ করে রোগের ঝুঁকি কমানো যেতে পারে। নিচে কিছু কার্যকর উপায় উল্লেখ করা হলো:
১. স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস
• সুষম ডায়েট: ফল, শাকসবজি, মুঠো মুঠো বাদাম, চর্বিযুক্ত মাছ, এবং কম প্রক্রিয়াজাত খাবার নিয়মিত গ্রহণ করুন।
• ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড: সামুদ্রিক মাছ (যেমন স্যামন, সারডিন) খান যা মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে।
• অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার: বেরি, তাজা ফল এবং যে সব সবজিতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যা মস্তিষ্কের কোষের ক্ষতি কমাতে সাহায্য করে সেই গুলো নিয়মিত গ্রহণ করুন।
২. শারীরিক কার্যকলাপ
• নিয়মিত ব্যায়াম: সপ্তাহে অন্তত ১৫০মিনিটের মাঝারি শারীরিক কার্যকলাপ, যেমন হাঁটা, সাইকেল চালানো বা সাঁতার কাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
• শক্তি ও স্থিতিস্থাপকতা প্রশিক্ষণ: ভারী জিনিস তোলার বা যোগব্যায়ামের মতো কার্যক্রম করুন, এই গুলো রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
৩. মস্তিষ্কের চ্যালেঞ্জ
• মানসিক উদ্দীপনা: পাজল, ক্রসওয়ার্ড, শব্দ খোঁজা, এবং নতুন কিছু শেখার মাধ্যমে মস্তিষ্ককে চ্যালেঞ্জ করুন। নিয়মিত বই পড়ুন, বিশেষ করে রহস্য, গোয়েন্দা বা ভ্রমণের উপর।
• নতুন কিছু শিখুন: যেমন হতে পারে নতুন ভাষা শেখা বা নতুন সঙ্গীত যন্ত্র বাজানো শেখা।
৪. সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখা
• সামাজিক যোগাযোগ: বন্ধু এবং পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত মেলামেশা করা এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করুন।
• ভলান্টিয়ারিং: স্থানীয় কমিউনিটিতে স্বেচ্ছাসেবী কাজ করুন, দেখবেন মস্তিস্ক ভাল কাজ করবে।
৫. মানসিক স্বাস্থ্য:
• স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট: যোগ, মেডিটেশন বা গভীর নিঃশ্বাসের মাধ্যমে মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করুন।
• আবেগজনিত সহায়তা: উদ্বেগ বা বিষণ্ণতা অনুভব করলে পেশাদার সাহায্য নিন। যেভাবেই হোক উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, টেনশন থেকে দূরে থাকুন।
৬. স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা
• নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে রাখুন। মনে রাখবেন এই রোগ গুলো আলঝেইমার ডিজিজের প্রধান কারণ।
• ধূমপান পরিহার করুন: ধূমপানের কারণে মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সবার আগে ধুপপান পরিহার করুন।
• মদ্যপানের নিয়ন্ত্রণ: মদ্যপান এড়ানো সবার জন্য প্রয়োজন। কারণ এটি ধীরে ধীরে মস্তিস্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
৭. সঠিক ঘুমের অভ্যাস
• নিয়মিত ঘুমের সময়সূচি: প্রতিদিন ৭-৯ ঘণ্টা ঘুমানোর চেষ্টা করুন। রাতে দ্রুত ঘুমাতে যান এবং খুব ভোরে ঘুম থেকে জেগে উঠুন এবং প্রথম সকালে হাটাহাটির নিয়মিত অভ্যাস করুন।
• ঘুমের পরিবেশ: একটি শান্ত এবং অন্ধকার ঘরে ঘুমান যাতে গভীর ঘুম নিশ্চিত হয়। মস্তিস্কের সুস্বাস্থ্যের জন্য অন্ধকার ঘরে ঘুমানো খুবই জরুরী।
৮. জ্ঞানীয় স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য
• আত্ম-শিক্ষা: আলঝেইমার ডিজিজ এবং ডিমেনশিয়া সম্পর্কে জানুন এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করুন।
আলঝেইমার ডিজিজের ঝুঁকি কমানোর জন্য উল্লিখিত উপায়গুলো কার্যকর। তবে, এই উপায়গুলি গ্রহণ করার পাশাপাশি স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শও গুরুত্বপূর্ণ। একজন স্বাস্থ্যকর্মী বা ডাক্তারের সঙ্গে নিয়মিত পরামর্শ করে নিজের স্বাস্থ্য ও রোগ প্রতিরোধের পরিকল্পনা তৈরি করা উচিত।
আলঝেইমার ডিজিজের লক্ষণগুলো ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় এবং ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনে গুরুতর প্রভাব ফেলে। প্রাথমিক পর্যায়ে লক্ষণগুলো হালকা হতে পারে, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এগুলো আরও গুরুতর হয়ে ওঠে। দ্রুত রোগ নির্ণয় এবং উপযুক্ত চিকিৎসা গ্রহণ রোগীর জীবনমান উন্নত করতে সহায়ক হতে পারে। যদি এই লক্ষণগুলোর কোনোটি দেখা যায়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
কোন মন্তব্য নেই