শিশুদের জলবসন্ত কী? বসন্তের লক্ষণ এবং প্রাথমিক চিকিৎসা
বসন্ত, যা চিকেনপক্স নামে পরিচিত, শিশুদের মধ্যে একটি সাধারণ এবং সংক্রামক রোগ। ভ্যাকসিন নেওয়া বসন্তের সবচেয়ে ভালো প্রতিরোধ ব্যবস্থা। চিকেনপক্স ভ্যাকসিন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাচ্চাদের বসন্ত থেকে রক্ষা করতে কার্যকরী। বাচ্চাদের বসন্ত হলে তাদের পরিচর্যার দিকে একটু বেশি মনোযোগ দিতে হবে, যেন তারা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে পারে। আজকে আমরা শিশুদের বসন্ত রোগ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
শিশুদের জলবসন্ত কী?
শিশুদের বসন্ত রোগ চিকেনপক্স (Chickenpox) নামে পরিচিত। এটি একটি সংক্রামক ভাইরাসজনিত
রোগ। এটি ভ্যারিসেলা-জোস্টার ভাইরাস
(Varicella-Zoster Virus) দ্বারা সৃষ্ট হয়। সাধারণত এই রোগটি শিশুদের মধ্যে খুব সাধারণ, তবে যেকোনো বয়সের মানুষই এতে আক্রান্ত হতে পারে। বসন্ত রোগ সাধারণত মৃদু হয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে, বিশেষ করে যদি রোগীর রোগপ্রতিরোধ
ক্ষমতা দুর্বল হয়।
শিশুদের জলবসন্ত কেন হয়?
ভাইরাসের কারণে: শিশুদের চিকেনপক্স সাধারণত ভাইরাসের সংক্রমণের
কারণে হয়। এই ভাইরাসটি খুবই সংক্রামক এবং এটি সহজেই এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। শিশুরা সাধারণত চিকেনপক্সে সংক্রমিত হয় তাদের দূর্বল প্রতিরোধ ব্যবস্থার (immune system) কারণে। শিশুদের সাধারণত জীবনীশক্তি
অনেক দূর্বল থাকে, সেজন্য তারা সহজেই ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে।
সরাসরি সংস্পর্শে আসলে: চিকেনপক্সের ভাইরাসটি ফুসকুড়ি বা দাগের সংস্পর্শের
মাধ্যমে ছড়াতে পারে। যদি কেউ চিকেনপক্সে আক্রান্ত হয় এবং তার ফুসকুড়ির
তরলে অন্য কেউ স্পর্শ করে, কিংবা ফুসকুড়ি বসে যাওয়ার পর সেই দাগে স্পর্শ করে তাহলে সে সহজেই এই ভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারে।
বাতাসের মাধ্যমে: চিকেনপক্স
আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি বা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে ভাইরাসটি বাতাসে ছড়ায়। অন্যরা যখন সেই বাতাসে শ্বাস নেয়, তখন তারা সহজেই এই ভাইরাসটি দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে।
ব্যবহৃত জিনিসপত্রের মাধ্যমে: চিকেনপক্সে আক্রান্ত ব্যক্তির পোশাক ও দৈনিক ব্যবহৃত জিনিসপত্র
থেকে অন্য কেউ খুব সহজে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। কারও চিকেনপক্স হলে তার পোশাক এবং দৈনিক ব্যবহৃত জিনিসপত্র
অন্যদের থেকে দূরে রাখতে হয়। যদি শিশুদের চিকেনপক্স হয় তবে তাদের জন্য আলাদা পরিস্কার পোশাক ও অন্যান্য জিনিপত্র আলাদা করে রাখতে হয়।
উচ্চ সংক্রমণ ক্ষমতার কারণে: চিকেনপক্স
অত্যন্ত সংক্রামক, এবং আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে খুব সহজেই অন্যরা আক্রান্ত হতে পারে। সংক্রমণটি সাধারণত একজন ব্যক্তির উপসর্গ দেখা দেওয়ার আগে ১-২ দিন এবং সমস্ত ফুসকুড়ি শুকিয়ে যাওয়ার পরেও কিছুদিন পর্যন্ত ছড়াতে পারে।
মেলামেশার
কারণে: শিশুদের মধ্যে এই রোগের দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার কারণ হল তারা প্রায়শই একসাথে খেলাধুলা করে, স্কুলে যায়, এবং একে অপরের কাছাকাছি থাকে, যা ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটানোর উপযুক্ত পরিস্থিতি
তৈরি করে।
শিশুদের জলবসন্তের লক্ষণ:
শিশুদের চিকেনপক্সের লক্ষণগুলি
সাধারণত সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে শুরু হয় এবং এটি ধীরে ধীরে বিকশিত হয়। লক্ষণগুলো
বেশ কয়েকটি ধাপে দেখা যেতে পারে। সাধারণ লক্ষণগুলো হলো:
প্রাথমিক লক্ষণ:
• জ্বর: হালকা থেকে মাঝারি মাত্রার জ্বর দেখা দেয়, যা প্রায় ১০০-১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট
পর্যন্ত হতে পারে।
• শরীরে ব্যথা ও ক্লান্তি:
শিশুরা সাধারণত ক্লান্তি ও দুর্বলতা অনুভব করতে পারে।
• মাথা ব্যথা: আক্রান্ত হওয়ার পর মাথা ব্যথা হওয়া একটি সাধারণ লক্ষণ।
• ক্ষুধামান্দ্য: চিকেনপক্সে
আক্রান্ত হলে শিশুরা খাওয়ার ব্যাপারে অনিচ্ছুক হতে পারে এবং তাদের ক্ষুধামান্দ্য হতে পারে।
ফুসকুড়ি এবং দাগ:
• লাল ফুসকুড়ি:
প্রথমে মুখ, মাথার তালু, বুক এবং পিঠে লাল ফুসকুড়ি দেখা দেয়, যা ধীরে ধীরে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।
• ফোস্কা বা পানিভর্তি দানা: ফুসকুড়িগুলো কিছু সময় পর ছোট ফোস্কা বা পানিভর্তি
দানায় রূপান্তরিত হয়। এগুলি সাধারণত চুলকায়।
• ফোস্কা শুকিয়ে যাওয়া: কয়েকদিন পর এই ফোস্কাগুলো ফেটে যায় এবং শুকিয়ে গিয়ে দাগ বা খোসায় পরিণত হয়, যা ধীরে ধীরে পড়ে যায়।
অন্যান্য লক্ষণ:
• চুলকানি: শরীরে ফুসকুড়ির কারণে খুব বেশি চুলকানি হতে পারে, যা শিশুদের জন্য অস্বস্তিকর হতে পারে।
• সাধারণ অসুস্থতা:
কিছু শিশু সামান্য অসুস্থতা বা অস্বস্তি অনুভব করতে পারে।
বিশেষ সতর্কতা:
চিকেনপক্সের লক্ষণগুলি সাধারণত সংক্রমণের
১০-২১ দিনের মধ্যে দেখা যায় এবং প্রায় ৫-১০ দিনের মধ্যে উন্নতি হয়। শিশুকে কোনও চিকিংসা না দিলেও এই ভাইরাস ৫-১০ দিনের মধ্যে সেরে যায়। যদি উপসর্গগুলি
গুরুতর হয় বা জটিলতা দেখা দেয়, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
শিশুরা জলবসন্তে আক্রান্ত হলে যা করবেন:
শিশুরা চিকেনপক্সে আক্রান্ত হলে তাদের আরাম এবং দ্রুত সুস্থতার জন্য কিছু সতর্কতা ও যত্ন নেওয়া জরুরি। নিম্নলিখিত
পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা উচিত:
• পর্যাপ্ত বিশ্রাম: শিশুকে বিশ্রাম করতে দিন এবং তার শরীরকে সুস্থ হতে সহায়তা করুন।
• অতিরিক্ত কার্যকলাপ
এড়ানো: অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম বা খেলাধুলার পরিবর্তে শিশুকে বিশ্রামে রাখুন।
• চুলকানি কমানো: চুলকানি কমাতে আক্রান্ত স্থানে ক্যালামাইন লোশন ব্যবহার করতে পারেন।
• ঠান্ডা পানিতে গোসল: ঠান্ডা বা কুসুম গরম পানিতে গোসল করালে চুলকানি কমে যেতে পারে। গোসলের পর আক্রান্ত স্থানগুলো
আলতো করে মুছে ফেলুন।
• নখ কেটে রাখা: শিশুর নখ কেটে ছোট রাখা ভালো, যাতে সে চুলকানোর ফলে ফোসকা বা ফুসকুড়ি আঘাত করতে না পারে এবং ইনফেকশন না ছড়ায়।
• তরল গ্রহণ: শিশুকে প্রচুর পানি এবং তরল পানীয় দিতে হবে যাতে সে পানিশূণ্য হয়ে না পড়ে। বিশেষ করে শিশুকে ডাবের পানি বা স্বাভাবিক পানি খেতে দিতে পারেন।
• পুষ্টিকর খাবার: শিশুকে সহজপাচ্য ও পুষ্টিকর খাবার যেমন স্যুপ, ফল, দুধ ইত্যাদি খেতে দিতে পারেন, যা শিশুর শক্তি পুনরুদ্ধারে সহায়ক হবে।
• জ্বর ও ব্যথা কমানো: শিশুর জ্বর এবং ব্যথা কমানোর জন্য প্যারাসিটামল ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে অ্যাসপিরিন এড়ানো উচিত কারণ এটি শিশুদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। তবে যে কোনো ওষুধ ব্যবহারের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের
পরামর্শ নেওয়া উচিত।
• অন্যদের থেকে আলাদা রাখা: যতক্ষণ না পর্যন্ত সমস্ত ফুসকুড়ি শুকিয়ে যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত শিশুকে অন্যান্য শিশুদের কাছ থেকে দূরে রাখা উচিত, যাতে সংক্রমণ ছড়িয়ে না পড়ে।
• স্কুলে না পাঠানো: চিকেনপক্স
থাকা অবস্থায় শিশুকে স্কুল বা কোনো জনসমাগমে না পাঠানোই ভালো।
• জটিলতা দেখা দিলে: যদি শিশুর শ্বাসকষ্ট
হয়, ফুসকুড়ি খুব বেশি ছড়িয়ে যায় বা অন্য কোনো গুরুতর লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
• অতিরিক্ত সংক্রমণ: যদি চুলকানোর ফলে ফোসকাগুলো
ইনফেকশন হয়ে যায়, তাহলে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হতে পারে। তখন অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
• পরিচ্ছন্ন পরিবেশ: শিশুর ঘর এবং তার আশেপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখা জরুরি। ফুসকুড়ির
সংক্রমণ এড়াতে পরিচ্ছন্ন
বিছানার চাদর এবং জামাকাপড় ব্যবহার করুন।
শিশুরা জলবসন্তে আক্রান্ত হলে যা করবেন না:
শিশুরা চিকেনপক্সে আক্রান্ত হলে কিছু কাজ থেকে বিরত থাকা জরুরি, যাতে সংক্রমণ না বাড়ে এবং শিশুর অবস্থা আরও খারাপ না হয়। নিচে উল্লেখ করা হলো কিছু বিষয় যা এড়ানো উচিত:
• চুলকানো থেকে বিরত রাখা: শিশুকে চুলকানো থেকে বিরত রাখুন কারণ এটি ফোসকা বা ফুসকুড়িতে
আঘাত হয়ে ইনফেকশন সৃষ্টি করতে পারে এবং দাগ দীর্ঘ দিন থেকে যেতে পারে।
• অ্যাসপিরিন নিষিদ্ধ: চিকেনপক্সে আক্রান্ত শিশুর জন্য অ্যাসপিরিন একেবারেই ব্যবহার করা উচিত নয়। এটি রেইয়ে সিনড্রোম নামক একটি বিরল রোগের সৃষ্টি করতে পারে। এই রোগ লিভার এবং মস্তিষ্কের ক্ষতি করতে পারে।
• গরম পানি এড়ানো: অতিরিক্ত গরম পানিতে গোসল করানো এড়িয়ে চলুন, কারণ এটি ফুসকুড়ি ও চুলকানি বাড়িয়ে দিতে পারে।
• জোর করে খাওয়ানো নয়: যদি শিশুর ক্ষুধা কমে যায়, তবে তাকে জোর করে খাওয়ানোর
চেষ্টা করবেন না। হালকা, সহজপাচ্য এবং পুষ্টিকর খাবার দেওয়ার চেষ্টা করুন এবং তাকে পর্যাপ্ত তরল পানীয় দিন।
• স্কুল বা জনসমাগমে না পাঠানো: যতক্ষণ না পর্যন্ত শিশুর সমস্ত ফোসকা শুকিয়ে যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে স্কুল বা জনসমাগম থেকে দূরে রাখা উচিত যাতে ভাইরাস অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে না পারে।
• সংস্পর্শ এড়ানো: পরিবারের অন্য সদস্যদের, বিশেষ করে যারা আগে কখনো চিকেনপক্সে আক্রান্ত হয়নি, তাদের থেকে শিশুকে আলাদা রাখুন।
এই বিষয়গুলো এড়িয়ে চললে শিশুর দ্রুত সুস্থতা নিশ্চিত করতে এবং ইনফেকশন বা জটিলতা কমাতে সাহায্য করবে।
কোন মন্তব্য নেই