Header Ads

ডায়াবেটিস কী? ডায়াবেটিস কেন ও কাদের হয় এবং প্রকারভেদ

বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিসের বৃদ্ধি একটি ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, যেমন বেশি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এবং উচ্চ-ক্যালোরি খাবারের গ্রহণ, এবং কম শারীরিক ক্রিয়াকলাপ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। আজকে আমরা ডায়াবেটিসের প্রকারভেদ ও লক্ষণগুলো নিয়ে আলোচনা করবো।

ডায়াবেটিস কী?

ডায়াবেটিস (Diabetes) একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ যা রক্তে শর্করার বা গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে ঘটে। এটি তখনই ঘটে যখন শরীর পর্যাপ্ত ইনসুলিন উৎপাদন করতে ব্যর্থ হয় বা উৎপাদিত ইনসুলিন সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে না। ইনসুলিন একটি হরমোন যা অগ্ন্যাশয় (pancreas) থেকে নিঃসৃত হয় এবং এটি রক্ত থেকে গ্লুকোজকে কোষে প্রবেশ করতে সাহায্য করে, যা দেহের শক্তির জন্য ব্যবহৃত হয়।


ডায়াবেটিস এর প্রকারভেদ:

ডায়াবেটিস বা বহুমুত্র রোগ মূলত শরীরে বড় ধরনের পরিবর্তন সাধন করে। প্রকারভেদ হিসেবে ডায়াবেটিসকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়, যথা:

১. টাইপ ১ ডায়াবেটিস (Type One Diabetes)

২. টাইপ ২ ডায়াবেটিস (Type Two Diabetes)

৩. গর্ভকালীন ডায়াবেটিস (Gestetional Diabetes) 

১. টাইপ ডায়াবেটিস:

টাইপ ডায়াবেটিস (Type 1 Diabetes) একটি দীর্ঘস্থায়ী অবস্থার ডায়াবেটিস যা প্যানক্রিয়াসের ইনসুলিন উৎপাদনকারী বেটা কোষের ক্ষতির কারণে হয়। ইনসুলিন একটি হরমোন যা রক্তে শর্করার বা গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। টাইপ ডায়াবেটিস প্রধানত শিশু এবং কিশোরদের মধ্যে দেখা দেয়, যদিও এটি যেকোন বয়সেও হতে পারে।

টাইপ ডায়াবেটিসের কারণ:

টাইপ ডায়াবেটিসের সুনির্দিষ্ট কারণ এখনও সম্পূর্ণভাবে বোঝা যায়নি, তবে এটি একটি অটোইমিউন ডিজঅর্ডার হিসেবে বিবেচিত হয়। এতে শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভুলক্রমে প্যানক্রিয়াসের ইনসুলিন উৎপাদনকারী বেটা কোষগুলিকে আক্রমণ করে এবং ধ্বংস করে। এর ফলে ইনসুলিনের পরিমাণ খুবই কমে যায় বা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়।

টাইপ ডায়াবেটিসের লক্ষণসমূহ:

টাইপ ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলি দ্রুত শুরু হতে পারে এবং অন্তর্ভুক্ত হতে পারে:

  • অতিরিক্ত তৃষ্ণা এবং ঘন ঘন প্রস্রাব
  • অতিরিক্ত ক্ষুধা
  • ওজন হ্রাস
  • ক্লান্তি এবং দুর্বলতা
  • দৃষ্টি সমস্যার বৃদ্ধি
  • ক্ষত দ্রুত নিরাময় না হওয়া
  • ইউটিপিআই বা ইউরিক এসিড ইনডেক্স বৃদ্ধি

টাইপ ডায়াবেটিস নির্ণয়:

টাইপ ডায়াবেটিস নির্ণয়ের জন্য সাধারণত নিচের পরীক্ষা গুলি করা হয়:

 রক্তের গ্লুকোজ স্তর পরীক্ষা

 গ্লুকোজ টোলারেন্স টেস্ট (GTT)

 ইনসুলিন এবং সিসিএ-এন্টিবডি টেস্ট

চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা:

টাইপ ডায়াবেটিসের কোনও নিরাময় নেই, তবে এটি কার্যকরভাবে পরিচালনা করা যায়। এর প্রধান চিকিৎসা পদ্ধতি হলো:

• ইনসুলিন থেরাপি: রক্তে ইনসুলিনের পর্যাপ্ত মাত্রা বজায় রাখতে নিয়মিত ইনসুলিন ইনজেকশন বা ইনসুলিন পাম্প ব্যবহার।

• রক্তের গ্লুকোজ পর্যবেক্ষণ: নিয়মিত রক্তের গ্লুকোজ স্তর পরীক্ষা করা।

• সুষম খাদ্য গ্রহণ: কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন এবং চর্বির সঠিক পরিমাণে গ্রহণ।

 নিয়মিত ব্যায়াম: শারীরিক কার্যকলাপ রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। 

২. টাইপ ডায়াবেটিস:

টাইপ ডায়াবেটিস (Type 2 Diabetes) হলো একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ যা সাধারণত বয়স্কদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। এটি তখন ঘটে যখন শরীর পর্যাপ্ত পরিমাণে ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না, বা শরীরের কোষগুলো ইনসুলিনের প্রতি সঠিকভাবে সাড়া দেয় না। এই অবস্থাকে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বলা হয়। টাইপ ডায়াবেটিস সবচেয়ে সাধারণ ডায়াবেটিস প্রকার এবং সাধারণত জীবনযাত্রা এবং খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের কারণে হয়।

টাইপ ডায়াবেটিসের কারণ:

টাইপ ডায়াবেটিসের প্রধান কারণগুলো অন্তর্ভুক্ত:

• জেনেটিক ফ্যাক্টর: পরিবারের কারও টাইপ ডায়াবেটিস থাকলে অন্য সদস্যদের রোগের ঝুঁকি বেশি।

• অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন: অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস, কম শারীরিক কার্যকলাপ এবং স্থূলতা টাইপ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়।

• বয়স: সাধারণত ৪৫ বছর বা তার বেশি বয়সের ব্যক্তিদের রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

 উচ্চ রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরল: এদের উপস্থিতি টাইপ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়।

টাইপ ডায়াবেটিসের লক্ষণসমূহ:

টাইপ ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলি ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে পারে, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত:

  • ঘন ঘন পিপাসা লাগা
  • ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া
  • অতিরিক্ত ক্ষুধা লাগা
  • ক্লান্তি দুর্বলতা
  • ঘা বা ক্ষত নিরাময়ে বেশি সময় নেওয়া
  • দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হওয়া

টাইপ ডায়াবেটিস নির্ণয়:

টাইপ ডায়াবেটিস নির্ণয়ের জন্য সাধারণত নিচের পরীক্ষা গুলি করা হয়:

• ফাস্টিং ব্লাড গ্লুকোজ টেস্ট (Fasting Blood Glucose Test): শারীরিক উপবাসের পর রক্তের গ্লুকোজ স্তর পরীক্ষা করা।

• এইচবিএ১সি (HbA1c) পরীক্ষা: গ্লুকোজের দীর্ঘমেয়াদী স্তর নির্ধারণ।

 ওরাল গ্লুকোজ টোলারেন্স টেস্ট (OGTT): গ্লুকোজের গ্রহণের পর শরীরের প্রতিক্রিয়া দেখা।

চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা:

টাইপ ডায়াবেটিসের ব্যবস্থাপনা করার জন্য নিচের উপায়গুলি অনুসরণ করা হয়:

• ওজন নিয়ন্ত্রণ: স্বাস্থ্যকর খাদ্য এবং নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা।

  স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: কার্বোহাইড্রেট নিয়ন্ত্রণ, শাকসবজি ফলমূলের সমৃদ্ধ খাদ্যগ্রহণ।

• ওষুধ এবং ইনসুলিন: কখনও কখনও ওষুধের পাশাপাশি ইনসুলিন থেরাপি প্রয়োজন হতে পারে।

• রক্তের গ্লুকোজ পর্যবেক্ষণ: নিয়মিত রক্তের গ্লুকোজ পর্যবেক্ষণ এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।

৩. গর্ভকালীন ডায়াবেটিস:

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস (Gestational Diabetes) হলো একটি ধরণের ডায়াবেটিস যা গর্ভাবস্থার সময় প্রথমবারের মতো দেখা দেয়। অবস্থায় শরীর পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না, যার ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায়। সাধারণত গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় বা তৃতীয় ত্রৈমাসিকে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস দেখা যায়, এবং গর্ভাবস্থা শেষ হওয়ার পর এটি সাধারণত চলে যায়। তবে এটি মায়ের শিশুর উভয়ের জন্য স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের কারণ:

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের সুনির্দিষ্ট কারণ এখনও পুরোপুরি বোঝা যায়নি, তবে এর প্রধান কারণ হলো গর্ভাবস্থায় হরমোনের পরিবর্তন। কিছু হরমোন ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে, যার ফলে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স দেখা দেয়। গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ঝুঁকিপূর্ণ কিছু ফ্যাক্টর অন্তর্ভুক্ত:

• অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা

• গর্ভাবস্থার আগে প্রিডায়াবেটিস থাকা

 পরিবারে টাইপ ডায়াবেটিসের ইতিহাস

 পূর্ববর্তী গর্ভাবস্থায় গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকা

 বড় ওজনের শিশুর জন্ম ( কেজি বা তার বেশি) হওয়া

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের লক্ষণসমূহ:

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলি সাধারণত স্পষ্ট নয় এবং কিছু ক্ষেত্রে লক্ষণহীনও থাকতে পারে। তবে কয়েকটি সাধারণ লক্ষণ হতে পারে:

  • অতিরিক্ত তৃষ্ণা লাগা
  • ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া
  • অতিরিক্ত ক্লান্তি
  • ধীরে ধীরে ওজন বৃদ্ধি

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নির্ণয়:

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস সাধারণত গর্ভাবস্থার ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহের মধ্যে স্ক্রিনিং পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়। এই পরীক্ষাগুলি অন্তর্ভুক্ত:

 গ্লুকোজ চ্যালেঞ্জ টেস্ট (Glucose Challenge Test): প্রথমে এক নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্লুকোজ পান করানো হয় এবং এক ঘণ্টা পরে রক্তের শর্করা স্তর পরীক্ষা করা হয়।

• ওরাল গ্লুকোজ টোলারেন্স টেস্ট (OGTT): গ্লুকোজ পান করানোর পর নির্দিষ্ট সময়ে রক্তের শর্করা স্তর পরীক্ষা করা হয়।

চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা:

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য নিচের পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করা হয়:

• স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ: শর্করা নিয়ন্ত্রিত, সুষম খাদ্য পরিকল্পনা।

• নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ: নিয়মিত হালকা ব্যায়াম যেমন হাঁটা বা যোগব্যায়াম করা।

• রক্তের গ্লুকোজ পর্যবেক্ষণ: রক্তের শর্করা নিয়মিত পরীক্ষা করা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ইনসুলিন বা অন্যান্য ওষুধ গ্রহণ করা।

• ওজন নিয়ন্ত্রণ: গর্ভাবস্থায় ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা।

ডায়াবেটিস এমন একটি সমস্যা যা দীর্ঘ সময় ধরে চলতে পারে এবং সময়মতো এর সঠিক ব্যবস্থাপনা না করলে এটি অন্যান্য জটিল শারীরিক সমস্যার কারণ হতে পারে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.