আমাশয় হলে যে ধরনের খাবার পরিহার করা উচিত
আমাশয় হলো একটি অন্ত্রের রোগ যা সাধারণত বড় অন্ত্র বা কোলনকে প্রভাবিত করে। এই রোগ সাধারণত দূষিত পানি বা খাবারের মাধ্যমে ছড়ায়। এটি এমন জায়গাগুলিতে বেশি দেখা যায় যেখানে স্বাস্থ্যকর স্যানিটেশন এবং নিরাপদ পানির অভাব রয়েছে। আমাশয়ে আক্রান্ত হলে বারে বারে পিচ্ছিল শ্লেষ্মা যুক্ত পায়খানা কিংবা ডায়রিয়া হতে পারে।
আমাশয় হলে যে সব খাবার খাবেন না:
কোনও ব্যক্তি আমাশয়ে আক্রান্ত হলে তার কিছু খাবার পরিহার করে চলতে হয় দ্রুত সুস্থ্য হওয়ার জন্য। নিম্নে এমন কিছু খাবার সম্পর্কে আলোচনা করা হলো যেগুলো আমাশয় আক্রান্ত রোগীকে পরিহার করা উচিত।
মসলাযুক্ত খাবার:
আমাশয় হলে
মসলাযুক্ত খাবার অবশ্যই পরিহার করা উচিত। মসলাযুক্ত খাবারে থাকা ঝাল ও অন্যান্য
মসলা অন্ত্রের সংবেদনশীল পেশিকে উত্তেজিত করে, যা অন্ত্রের
প্রদাহ এবং ব্যথাকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। এতে, শ্লেষ্মা, ডায়রিয়া ও পেটের ব্যথার মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার ঝুঁকি
থাকে। এ সময় সহজপাচ্য, হালকা এবং কম
মসলাযুক্ত খাবার খাওয়া ভালো, যা অন্ত্রের আরাম
নিশ্চিত করতে সহায়তা করে।
যে সমস্ত
মসলাযুক্ত খাবার আমাশয়ের সময় এড়িয়ে চলা উচিত সেগুলো হলো:
• মরিচ, কাঁচা মরিচ, শুকনো মরিচ গুঁড়া
• গরম মসলা, যেমন এলাচ, লবঙ্গ, দারুচিনি
• মশলাদার সস এবং চাটনি
• তেঁতুল বা টক জাতীয় খাবার
• ঝাল এবং মশলাদার কারি বা ভাজাপোড়া খাবার
দুগ্ধজাত খাবার:
আমাশয় হলে
দুগ্ধজাত খাবার পরিহার করা উচিত। আমাশয়ের কারণে অন্ত্রে ল্যাকটোজ হজমের সমস্যা হতে
পারে, যা ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স নামে পরিচিত। এই
অবস্থায় দুধ বা দুগ্ধজাত খাবার খেলে পেটের গ্যাস, ফাঁপা, ডায়রিয়া, শ্লেষ্মা ও পেটের
ব্যথা আরও বেড়ে যেতে পারে। দুগ্ধজাত খাবারের পরিবর্তে, এই সময়ে আপনি দুধের বিকল্প হিসেবে ল্যাকটোজ-মুক্ত দুধ বা
বাদাম/সয়া দুধ ব্যবহার করতে পারেন, যা অন্ত্রের ওপর কম
প্রভাব ফেলে।
যে সমস্ত
দুগ্ধজাত খাবার আমাশয়ের সময় এড়িয়ে চলা উচিত সেগুলো হলো:
• দুধ
• দই (বিশেষত মিষ্টি দই)
• পনির
• মাখন
• আইসক্রিম
• অন্যান্য দুগ্ধজাত প্রক্রিয়াজাত খাবার
তৈলাক্ত ও ভাজাপোড়া খাবার:
আমাশয় হলে
তৈলাক্ত ও ভাজাপোড়া খাবার পরিহার করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরনের খাবারগুলি হজম
করা কঠিন এবং অন্ত্রে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, যা পেটের
ব্যথা ও ডায়রিয়াকে আরও তীব্র করে তুলতে পারে। এসময় হালকা, সহজপাচ্য,
এবং কম
চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া ভালো। যেমন: সেদ্ধ করা চাল, সবজি, স্যুপ, এবং সিদ্ধ খাবার, যা অন্ত্রকে আরাম দেয় এবং হজমে সহায়তা করে।
যে ধরনের
তৈলাক্ত ও ভাজাপোড়া খাবার এড়িয়ে চলা উচিত সেগুলো হলো:
• ভাজা খাবার (যেমন, চপ, পুরি, পরোটা, সমুচা, গ্রিল, মোগলাই, পকোড়া)
• অতিরিক্ত তেলে রান্না করা খাবার (যেমন, ফাস্ট ফুড,
বার্গার, পিৎজা)
• গুরুপাক খাবার যেগুলোতে অতিরিক্ত তেল বা
মাখন ব্যবহার করা হয়
• চর্বিযুক্ত খাবার (যেমন, ফ্যাটযুক্ত মাংস, ঘি)
ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার:
আমাশয় হলে
উচ্চ ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার পরিহার করা উচিত। কারণ, ফাইবারসমৃদ্ধ
খাবার অন্ত্রের গতি বাড়িয়ে দিতে পারে,
যা ডায়রিয়াকে
আরও তীব্র করতে পারে এবং পেটের ব্যথা বাড়াতে পারে। এই সময় অন্ত্রকে আরাম দিতে
হালকা ও সহজপাচ্য খাবার খাওয়া ভালো। এই সব খাবারের পরিবর্তে, সাদা চাল,
সেদ্ধ আলু, টোস্ট, এবং কলা জাতীয় হালকা ও
কম ফাইবারযুক্ত খাবার খাওয়া উচিত, যা অন্ত্রের আরাম এবং
হজমের প্রক্রিয়াকে সহায়তা করে।
যে ধরনের উচ্চ
ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার এড়িয়ে চলা উচিত সেগুলো হলো:
• কাঁচা শাকসবজি (যেমন, বাঁধাকপি,
ব্রকলি, গাজর)
• আঁশযুক্ত ফলমূল (যেমন, আপেল, নাশপাতি, বেরি)
• বাদাম ও বীজ (যেমন, বাদাম, চিয়া সিড, ফ্ল্যাক্স সিড)
• গোটা শস্যের রুটি ও সিরিয়াল (যেমন, গমের রুটি,
ব্রাউন রাইস, ওটমিল)
• শিমজাতীয় খাবার (যেমন, মটরশুঁটি,
মসুর ডাল)
মিষ্টি জাতীয় খাবার:
আমাশয় হলে
মিষ্টি জাতীয় খাবার পরিহার করা উচিত। মিষ্টি জাতীয় খাবার এবং পানীয় অন্ত্রে পানি
টেনে নিয়ে আসতে পারে, যা ডায়রিয়াকে আরও
তীব্র করতে পারে এবং পেটের সমস্যাকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। অতিরিক্ত চিনি অন্ত্রের
ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধিকেও উৎসাহিত করতে পারে, যা সংক্রমণ আরও
বাড়ায়। এ সময় হালকা, সহজপাচ্য খাবার এবং
প্রচুর পরিমাণে পানি খাওয়া উচিত, যেন শরীরের পানির
ভারসাম্য বজায় থাকে। সহজ শর্করা বা প্রাকৃতিক মিষ্টি জাতীয় খাবার যেমন কলা, যা হালকা এবং সহজপাচ্য, তেমন খাবার
খান।
যে ধরনের
মিষ্টি খাবার এবং পানীয় এড়িয়ে চলা উচিত সেগুলো হলো:
• কেক, পেস্ট্রি, মিষ্টি
• চকলেট এবং ক্যান্ডি
• সফট ড্রিঙ্কস ও সোডা
• মিষ্টিজাত পানীয় (যেমন ফলের জুস, মিষ্টি চা,
এনার্জি
ড্রিঙ্ক)
• আইসক্রিম এবং অন্যান্য মিষ্টি দুগ্ধজাত
খাবার
ক্যাফেইন যুক্ত খাবার:
আমাশয় হলে
ক্যাফেইনযুক্ত খাবার এবং পানীয় পরিহার করা উচিত। ক্যাফেইন অন্ত্রের পেশিগুলিকে
উদ্দীপিত করে এবং অন্ত্রের গতি বাড়িয়ে দেয়, যা ডায়রিয়াকে
আরও খারাপ করতে পারে। এছাড়া, ক্যাফেইন একটি
মূত্রবর্ধক (diuretic) খাবার, যা শরীর থেকে পানি বের করে দেয়, ফলে ডায়রিয়া হলে শরীরে পানির ঘাটতি আরও বাড়তে পারে।
ক্যাফেইনের পরিবর্তে, ক্যাফেইনমুক্ত হালকা
পানীয়, যেমন গরম পানি, আদা চা, বা ভেষজ চা পান করা
ভালো। এসময় প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি খাওয়া উচিত, যেন শরীরের পানির ভারসাম্য বজায় থাকে এবং ডিহাইড্রেশন
এড়ানো যায়।
যে ধরনের
ক্যাফেইনযুক্ত খাবার এবং পানীয় এড়িয়ে চলা উচিত সেগুলো হলো:
• কফি
• চা (যা ক্যাফেইনযুক্ত)
• সফট ড্রিঙ্কস এবং কোলা জাতীয় পানীয়
• এনার্জি ড্রিঙ্কস
• চকোলেট এবং কোকো পাউডার
অ্যালকোহল:
আমাশয় হলে
অ্যালকোহল পরিহার করা অত্যন্ত জরুরি। অ্যালকোহল অন্ত্রের ঝিল্লিকে উত্তেজিত করে
এবং হজম প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে, যা ডায়রিয়া ও পেটের
সমস্যাকে আরও তীব্র করতে পারে।
অ্যালকোহলের
নেতিবাচক প্রভাবগুলির মধ্যে রয়েছে:
• অন্ত্রের প্রদাহ বৃদ্ধি করা
• হজমের গতি বাড়িয়ে দিয়ে ডায়রিয়া আরও তীব্র
করা
• শরীর থেকে গুরুত্বপূর্ণ ইলেকট্রোলাইট এবং
তরল বের করে দেওয়া
তাই, আমাশয়ের সময় অ্যালকোহল সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে চলা উচিত এবং
তার পরিবর্তে প্রচুর পরিমাণে পানি, নারকেলের পানি, অথবা ইলেকট্রোলাইট সমৃদ্ধ পানীয় খাওয়া উচিত, যা শরীরের পানির ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করবে।
গ্যাস সৃষ্টিকারী খাবার:
আমাশয় হলে
গ্যাস সৃষ্টিকারী খাবার পরিহার করা উচিত, কারণ এই ধরনের
খাবার অন্ত্রের গ্যাস, ফাঁপা, এবং অস্বস্তি বাড়িয়ে দেয়, যা পেটের
ব্যথা ও ডায়রিয়াকে আরও খারাপ করতে পারে।
যে ধরনের
গ্যাস সৃষ্টিকারী খাবার এড়িয়ে চলা উচিত সেগুলো হলো:
• শিমজাতীয় খাবার: মটরশুঁটি, চানা, মসুর ডাল, সয়াবিন
• ক্রুসিফেরাস সবজি: বাঁধাকপি, ব্রকলি, ফুলকপি, ব্রাসেলস স্প্রাউট
• কাঁচা পেঁয়াজ এবং রসুন: এগুলোও হজমে সমস্যা
এবং গ্যাস তৈরি করতে পারে।
• কার্বোনেটেড পানীয়: সোডা, সফট ড্রিঙ্কস, এবং অন্যান্য
ফিজি ড্রিঙ্কস গ্যাস তৈরি করে।
• চিনি এবং কৃত্রিম মিষ্টি: কিছু চিনি এবং
মিষ্টি যেমন সোर्बিটল, ফ্রুক্টোজ অন্ত্রে ফারমেন্ট হয়ে গ্যাস সৃষ্টি করে।
• চিকুরি রুট এবং ফাইবারযুক্ত প্রোডাক্ট:
এগুলো হজমে সমস্যা তৈরি করতে পারে এবং গ্যাসের সৃষ্টি করে।
এসময় সহজপাচ্য, কম ফাইবার এবং কম গ্যাস সৃষ্টিকারী খাবার যেমন সেদ্ধ চাল, সেদ্ধ আলু, কলা, এবং স্যুপ খাওয়া উচিত, যা অন্ত্রকে আরাম দেয় এবং গ্যাস ও অস্বস্তি কমাতে সাহায্য করে।
কোন মন্তব্য নেই