গর্ভকালীন ডায়াবেটিস কী? আক্রান্তের কারণ, লক্ষণ এবং জটিলতা
ডায়াবেটিস বর্তমান সময়ের সবচেয়ে পরিচিত একটি সমস্যা। ডায়াবেটিসের কারণে শরীরে আরও বিভিন্ন জটিল সমস্যার তৈরি হতে পারে। এই রোগের প্রধানত তিনটি শ্রেণীবিভাগ রয়েছে। এই শ্রেণীবিভাগ গুলোর মধ্যে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস একটি প্রধান প্রকার। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস একটি বিশেষ ধরনের ডায়াবেটিস, যা সাধারণত গর্ভধারণের সময় দেখা দেয়। আজকের আলোচনায় আমরা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
গর্ভকালীন
ডায়াবেটিস কী?
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস (Gestational Diabetes) হলো গর্ভাবস্থায় প্রথমবারের মতো দেখা দেওয়া এক ধরণের ডায়াবেটিস। এটি তখন ঘটে যখন গর্ভবতী মহিলার শরীর পর্যাপ্ত পরিমাণে ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না, যার ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায়। সাধারণত গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় বা তৃতীয় ত্রৈমাসিকে এটি দেখা দেয় এবং গর্ভাবস্থার পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি সুস্থ্য হয়ে যায়। তবে, এটি মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, তাই নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস মেনে চলা গুরুত্বপূর্ণ।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের কারণ:
গর্ভকালীন
ডায়াবেটিসের প্রধান কারণ হলো হরমোনজনিত পরিবর্তন। গর্ভাবস্থায়, প্লাসেন্টা থেকে কিছু হরমোন নিঃসৃত হয়, যা ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে। ইনসুলিন
রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, কিন্তু
ইনসুলিন-প্রতিরোধী হরমোনের কারণে মায়ের শরীর সেই পরিমাণ ইনসুলিন তৈরি করতে পারে
না, যা রক্তের শর্করার পরিমাণকে স্বাভাবিক রাখতে
প্রয়োজন। গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের আরও কিছু কারণ রয়েছে, নিম্নে সেই কারণ গুলো বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
অতিরিক্ত ওজন:
গর্ভাবস্থার
আগে বা গর্ভাবস্থায় ওজন বেশি থাকলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। অতিরিক্ত ওজনের ফলে
শরীরে ইনসুলিন প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়, যা
গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এই সময় শরীর ইনসুলিন তৈরি করে
রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে, কিন্তু ওজন
বেশি হলে ইনসুলিন ঠিকমতো কাজ করতে পারে না এবং রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যেতে
পারে।
পারিবারিক ইতিহাস:
গর্ভকালীন
ডায়াবেটিসের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো "পারিবারিক ইতিহাস" বা পরিবারে
ডায়াবেটিসের ইতিহাস থাকা। পরিবারের কারো ডায়াবেটিস থাকলে শরীরে ইনসুলিন প্রতিরোধের
ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়, যা গর্ভাবস্থায়
ডায়াবেটিসের কারণ হতে পারে। জেনেটিক কারণের জন্য এই ঝুঁকি অনেক সময় বৃদ্ধি পায়, এবং যারা এই ধরনের পারিবারিক ইতিহাস বহন করেন, তাদের ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে
যাওয়ার আশংকা থাকে।
বয়স বেশি হওয়া:
গর্ভকালীন
ডায়াবেটিসের আরেকটি সাধারণ কারণ হলো গর্ভবতী মায়ের বয়স বেশি হওয়া, বিশেষ করে ২৫ বা ৩০ বছরের বেশি বয়সে প্রথমবারের মতো
গর্ভধারণ করা। বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীরের ইনসুলিন ব্যবহারের ক্ষমতা কিছুটা কমে
যেতে পারে, এবং এই কারণে ইনসুলিন
প্রতিরোধ বৃদ্ধি পেতে পারে। ইনসুলিন প্রতিরোধ বৃদ্ধির ফলে শরীর রক্তের গ্লুকোজ
ঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না এবং এর ফলস্বরূপ গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হওয়ার
ঝুঁকি বাড়ে।
পূর্বে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকলে:
পূর্বে
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকা ভবিষ্যতে আবার গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হওয়ার একটি বড় কারণ
হিসেবে বিবেচিত। যেসব মায়েদের প্রথম গর্ভাবস্থায় গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হয়েছিল, তাদের পরবর্তী গর্ভধারণে এই ডায়াবেটিস পুনরায় দেখা দিতে
পারে। এই ঝুঁকি বাড়ার কারণ হলো প্রথমবার গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকলে শরীরের ইনসুলিন
ব্যবহারের সমস্যা থেকে যায় এবং পরবর্তীতে শরীর আবারও ইনসুলিন প্রতিরোধে অক্ষম হয়ে
পড়তে পারে। এর ফলে, রক্তে গ্লুকোজের
পরিমাণ বেড়ে যায় এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম:
পলিসিস্টিক
ওভারিয়ান সিন্ড্রোম (PCOS) থাকা গর্ভকালীন
ডায়াবেটিসের একটি সাধারণ ঝুঁকিপূর্ণ কারণ। পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোমে
আক্রান্ত নারীদের শরীরে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বেশি হয়, যার ফলে শরীর ইনসুলিন ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে না এবং
রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। PCOS-এর কারণে
হরমোনের ভারসাম্যহীনতা হয়, যা ইনসুলিনের
কার্যকারিতায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
পূর্বে বেশি ওজনের শিশু জন্ম দেয়া:
পূর্বে ৪.১
কেজির (৯ পাউন্ডের বেশি) ওজনের শিশু জন্ম দেয়া গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ঝুঁকির একটি
কারণ হতে পারে। এই ধরনের উচ্চ ওজনের শিশুর জন্ম অনেক সময় মায়ের শরীরে ইনসুলিনের
কার্যক্ষমতার সমস্যার ইঙ্গিত দেয়, যা গর্ভাবস্থায়
ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে। মূলত, উচ্চ ওজনের
শিশুর জন্ম দিতে গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরে গ্লুকোজের পরিমাণ বেশি থাকলে শিশুও বেশি
গ্লুকোজ গ্রহণ করে, যা শিশুর ওজন বৃদ্ধির
কারণ হতে পারে।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের লক্ষণ:
গর্ভকালীন
ডায়াবেটিস সাধারণত অনেক সময় লক্ষণবিহীন থাকতে পারে। তবে কিছু ক্ষেত্রে সামান্য
লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে, যেমন:
- অতিরিক্ত তৃষ্ণা অনুভব: বারবার তৃষ্ণা লাগা বা পানি পান করতে ইচ্ছে করা।
- ঘন ঘন প্রস্রাব করা: বিশেষত রাতে প্রস্রাবের চাপ বৃদ্ধি পাওয়া।
- অতিরিক্ত ক্ষুধা অনুভব করা: ঘন ঘন ক্ষুধা লাগা বা খাবার খাওয়ার ইচ্ছা করা।
- অস্বাভাবিক ক্লান্তি: সামান্য কাজেই ক্লান্ত হয়ে পড়া।
- ঝাপসা দৃষ্টি: কখনও কখনও চোখে ঝাপসা দেখা বা দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া।
গর্ভাবস্থার
সময় এসব লক্ষণ দেখা দিলে, চিকিৎসকের সঙ্গে
যোগাযোগ করা উচিত। সাধারণত গর্ভাবস্থার ২৪-২৮ সপ্তাহের মধ্যে গ্লুকোজ টলারেন্স
টেস্ট (OGTT) করা হয়, যা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নির্ণয়ে সাহায্য করে।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের জটিলতা সমূহ:
গর্ভকালীন
ডায়াবেটিস বিভিন্ন ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে, যা মায়ের
স্বাস্থ্য ও গর্ভের সন্তানের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের কিছু
সাধারণ জটিলতা হলো:
শিশুর জন্য জটিলতা:
উচ্চ ওজন নিয়ে
জন্ম: অতিরিক্ত গ্লুকোজ শিশুর শরীরে ফ্যাট হিসেবে জমা হতে পারে, ফলে শিশু উচ্চ ওজন ৪ কেজি বা তার বেশি নিয়ে জন্ম নিতে
পারে। এটি প্রসব জটিলতাও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
প্রি-টার্ম
জন্ম: মায়ের উচ্চ গ্লুকোজের কারণে প্রি-টার্ম (সময় পূর্ণ হওয়ার আগে) জন্ম হতে পারে, যা শিশুর স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ায়।
নিওনেটাল
হাইপোগ্লাইসেমিয়া: শিশুর জন্মের পর রক্তে শর্করার পরিমাণ হঠাৎ কমে যেতে পারে, কারণ তার শরীর জন্মের পরেও উচ্চ মাত্রায় ইনসুলিন তৈরি
করে যায়।
শ্বাসকষ্টের
সমস্যা: প্রি-টার্ম জন্ম হলে শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হতে পারে।
ভবিষ্যতে
ডায়াবেটিসের ঝুঁকি: শিশুর পরবর্তী জীবনে টাইপ ২ ডায়াবেটিস বা ওবেসিটির ঝুঁকি বাড়তে
পারে।
মায়ের জন্য জটিলতা:
প্রি-এক্ল্যাম্পসিয়া:
উচ্চ রক্তচাপ ও প্রোটিন ইউরিনে মিশে গিয়ে প্রি-এক্ল্যাম্পসিয়ার ঝুঁকি বাড়াতে পারে, যা মায়ের ও সন্তানের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
প্রসবে
জটিলতা: উচ্চ ওজনের শিশুর কারণে প্রসবের সময় সিজারিয়ান সেকশন বা অস্ত্রোপচারের
প্রয়োজন হতে পারে।
টাইপ ২
ডায়াবেটিসের ঝুঁকি: গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হওয়ার পর, ভবিষ্যতে টাইপ
২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে।
গর্ভধারণে পুনরায় ডায়াবেটিস হওয়ার আশংকা: একবার গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হলে
পরবর্তী গর্ভধারণেও এ সমস্যা হওয়ার আশংকা থাকে।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস প্রতিরোধ:
গর্ভকালীন
ডায়াবেটিস প্রতিরোধে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ
করা যেতে পারে। যদিও গর্ভকালীন ডায়াবেটিস পুরোপুরি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, তবে নিচের পরামর্শগুলো অনুসরণ করলে ঝুঁকি অনেকটাই কমানো
সম্ভব:
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা:
• স্বাস্থ্যকর খাবার
খাওয়া: শর্করা ও চর্বিযুক্ত খাবারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে প্রোটিন, শাকসবজি, ফলমূল ও আঁশযুক্ত
খাবার বেশি খেতে হবে।
• সুষম খাদ্য গ্রহণ:
প্রতিদিন একসাথে বেশি খাবার না খেয়ে,
দিনের মধ্যে
ছোট ছোট পরিমাণে খাবার খাওয়া ভালো।
নিয়মিত ব্যায়াম করা:
• গর্ভাবস্থায় চিকিৎসকের
পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত হালকা ব্যায়াম যেমন হাঁটা, যোগব্যায়াম,
এবং সাঁতার
করা উপকারী।
• নিয়মিত ব্যায়াম
রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে এবং ইনসুলিনের কার্যকারিতা
বাড়ায়।
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা:
• গর্ভধারণের আগে এবং
গর্ভাবস্থার সময় ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। অতিরিক্ত ওজন গর্ভকালীন
ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়, তাই ওজন স্বাস্থ্যকর
মাত্রায় রাখার চেষ্টা করা উচিত।
রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করা:
• যদি গর্ভকালীন
ডায়াবেটিসের ঝুঁকি থাকে, তবে গর্ভাবস্থার শুরু
থেকে নিয়মিত রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করা জরুরি। গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্টের
মাধ্যমে শর্করার মাত্রা সহজেই নির্ণয় করা যায়।
স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন বজায় রাখা:
• ধূমপান এবং মদ্যপান
এড়িয়ে চলা।
• মানসিক চাপ কমানোর
চেষ্টা করা এবং পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা।
পরিবার পরিকল্পনা:
• যদি অতীতে গর্ভকালীন
ডায়াবেটিস হয়ে থাকে, তবে পরবর্তী
গর্ভধারণের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
এই সকল
পদক্ষেপ অনুসরণ করলে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমানো সম্ভব, তবে যাদের জিনগত ঝুঁকি বেশি, তাদের জন্য নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
কোন মন্তব্য নেই