ভিমরুল কামড়ালে কী করবেন? কী চিকিৎসা নিবেন !
ভিমরুল (Hornet) একটি বৃহৎ এবং আক্রমণাত্মক পতঙ্গ, যা বোলতা (wasp) পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। ভিমরুলের কামড় অনেক বেশি ব্যথাদায়ক এবং বিপজ্জনক হতে পারে, কারণ এর বিষে এমন উপাদান থাকে যা প্রদাহ এবং ব্যথা সৃষ্টি করে। এটি সাধারণত গ্রীষ্ম এবং শরৎকালে বেশি সক্রিয় থাকে এবং নিজের বাসা বা কলোনির আশপাশে বিপদসঙ্কেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে।
ভিমরুল বোলতার চেয়ে বড় হয় এবং এদের দৈর্ঘ্য সাধারণত ২-৩ সেমি (১-১.২ ইঞ্চি) পর্যন্ত হতে পারে। এদের গায়ের রং সাধারণত কালো এবং হলুদ বা কমলা রঙের হয়ে থাকে। ভিমরুলেরা মাটির গর্তে, গাছের ডালে বা ভবনের ফাঁকা অংশে বাসা বানাতে পছন্দ করে। ভিমরুলেরা দলগতভাবে বাস করে, এবং একসাথে মিলে কাজ করে।
ভিমরুলে কী ধরনের বীষ থাকে:
ভিমরুলের বিষ হলো একটি জটিল রাসায়নিক মিশ্রণ, যা প্রোটিন, এনজাইম, এবং অন্যান্য উপাদান দিয়ে তৈরি। এই বিষটি ভিমরুল কামড়ানোর সময় শরীরে প্রবেশ করে এবং তাৎক্ষণিকভাবে ব্যথা, ফোলাভাব, এবং প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। ভিমরুলের বিষের প্রধান উপাদানগুলোর মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য হলো:
মেলিটিন (Melittin):
এটি ভিমরুলের বিষের প্রধান উপাদান, যা তীব্র ব্যথা ও প্রদাহ সৃষ্টি করে। মেলিটিন রক্তের কোষগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং স্নায়ু কোষগুলোকেও উত্তেজিত করে, যার ফলে ব্যথা অনুভূত হয়।
ফসফোলিপেজ (Phospholipase):
এই এনজাইমটি চামড়ার কোষ ও রক্তকোষের ঝিল্লিকে ভেঙে দেয়, যার ফলে ফোলাভাব ও প্রদাহ সৃষ্টি হয়। এটি অন্যান্য বিষাক্ত উপাদানগুলোর কাজকে আরও তীব্র করে তোলে।
হাইলুরোনিডেজ (Hyaluronidase):
হাইলুরোনিডেজ এনজাইমটি বিষকে আশেপাশের টিস্যুতে ছড়িয়ে দেয়, যার ফলে প্রদাহ ও চুলকানি দেখা দিতে পারে। এটি বিষের দ্রুত বিস্তার ঘটাতে সাহায্য করে, যা বিষক্রিয়া আরও বাড়িয়ে দেয়।
হিস্টামিন (Histamine):
বিষের মধ্যে থাকা হিস্টামিন শরীরের ইমিউন প্রতিক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে, যার ফলে চুলকানি, ফোলাভাব, এবং প্রদাহ দেখা দেয়। এটি অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়ার জন্য দায়ী।
ভিমরুল কামড়ানোর লক্ষণ সমূহ:
ভিমরুল কামড়ালে বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিতে পারে, যা সাধারণত ব্যক্তির শারীরিক অবস্থা ও অ্যালার্জির উপস্থিতির উপর নির্ভর করে। নিচে সাধারণ ও গুরুতর উপসর্গগুলোর বিবরণ দেওয়া হলো:
সাধারণ উপসর্গ:
তীব্র ব্যথা ও জ্বালাপোড়া: কামড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই তীব্র ব্যথা ও জ্বালাপোড়া অনুভূত হয়।
লালচে ভাব ও ফোলাভাব: কামড়ের স্থানে লালচে দাগ এবং ফোলাভাব দেখা যায়।
চুলকানি: কামড়ের স্থানটি চুলকাতে পারে এবং কিছু সময় পর আরও বেশি সংবেদনশীল হয়ে উঠতে পারে।
উষ্ণতা অনুভব: কামড়ের স্থানে তাপ অনুভূত হতে পারে।
হালকা র্যাশ: কিছুক্ষেত্রে কামড়ের চারপাশে ছোট ছোট র্যাশ বা ফুসকুড়ি দেখা যেতে পারে।
গুরুতর অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া:
গুরুতর অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া অনেক সময় জীবন-হুমকির কারণ হতে পারে। এ ধরনের প্রতিক্রিয়ার উপসর্গগুলো হলো:
শ্বাসকষ্ট বা শ্বাস নিতে সমস্যা: গলা বা বুক চেপে ধরার মতো অনুভূতি হতে পারে।
মাথা ঘোরা বা বমিভাব: মাথা ঘোরা, দুর্বলতা বা বমিভাব হতে পারে।
হাত-পা বা মুখের ফোলাভাব: ঠোঁট, জিহ্বা, চোখের চারপাশে বা গলার ফোলাভাব দেখা যেতে পারে।
তীব্র র্যাশ বা ফুসকুড়ি: সারা শরীরে ফুসকুড়ি বা চুলকানির মতো র্যাশ দেখা দিতে পারে।
চেতনা হারানো: রক্তচাপ হঠাৎ কমে গিয়ে চেতনা হারানোর সম্ভাবনা থাকে।
ভিমরুল কামড়ালে কি করবেন:
ভিমরুলে কামড়ালে দ্রুত কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি, কারণ এটির কামড় বেশ ব্যথা এবং ফোলাভাব সৃষ্টি করতে পারে। নিচে কিছু পদক্ষেপ দেওয়া হলো যা আপনি অনুসরণ করতে পারেন:
কামড়ের স্থান থেকে সরে যান: ভিমরুলেরা আক্রমণ করার পর পিছু নেয়, তাই যত দ্রুত সম্ভব সেই স্থান থেকে সরে যান।
স্টিং সরিয়ে ফেলুন: যদি ভিমরুলের স্টিং (ডাঁশ) ত্বকে আটকে থাকে, তাহলে সেটি সরিয়ে ফেলুন। এটির জন্য পিন বা কার্ডের সাহায্যে সাবধানে সরান।
ঠান্ডা প্যাক ব্যবহার করুন: কামড়ের স্থানে ঠান্ডা প্যাক বা বরফ দিয়ে চেপে ধরুন। এটি ব্যথা এবং ফোলাভাব কমাতে সাহায্য করবে। ১০-১৫ মিনিট ধরে ঠান্ডা প্যাক লাগিয়ে রাখুন, তবে সরাসরি বরফ ত্বকে লাগাবেন না।
অ্যান্টিহিস্টামিন ওষুধ: ফোলাভাব বা চুলকানি কমানোর জন্য অ্যান্টিহিস্টামিন যেমন: সিট্রিজিন বা ডিফেনহাইড্রামিন ওষুধ নিতে পারেন। তবে, ওষুধ নেওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত।
ব্যথানাশক ওষুধ: যদি ব্যথা বেশি হয়, তাহলে প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেনের মতো ব্যথানাশক ওষুধ খেতে পারেন।
ক্ষতস্থান পরিষ্কার রাখুন: কামড়ের স্থানটি পরিষ্কার পানি ও সাবান দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে নিন।
সংক্রমণ এড়াতে নজর দিন: কামড়ের স্থানে যদি লালচে ভাব, ফোলাভাব বা পুঁজ দেখা যায়, তাহলে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, কারণ এটি সংক্রমণের লক্ষণ হতে পারে।
জরুরি অবস্থায় ডাক্তারের পরামর্শ নিন: যদি শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা, বুক ধড়ফড়, ত্বকে ফুসকুড়ি বা চেতনা হারানোর মতো অ্যালার্জির লক্ষণ দেখা যায়, তাহলে জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।
ভিমরুলের বিষের উপাদানগুলো একসঙ্গে কাজ করে এবং শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সক্রিয় করে, যা অনেক সময় মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে। ভিমরুলের কামড়ে অনেকের অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া হতে পারে, যা মারাত্মক হতে পারে। তাই এসব লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যান। ভিমরুলের কামড়কে হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়, বিশেষ করে যদি কেউ পূর্বে অ্যালার্জির সমস্যায় ভুগে থাকেন।
কোন মন্তব্য নেই