নারীদের অনিয়মিত পিরিয়ড নিয়মিত করার ১০টি উপায়
পিরিয়ড (Period) বা মাসিক নারীদের একটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়ম। এটি একটি শারীরিক সাইকেলের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়। বিভিন্ন কারণে নারীদের পিরিয়ড প্রক্রিয়া নিয়মিত থেকে অনিয়মিত হয়ে যেতে পারে। তবে এটি খারাপ জটিলতার দিকে যাওয়ার পূর্বে কিছু উপায়ের মাধ্যমে স্বাভাবিক করা যায়। আজকের আলোচনায় আমরা অনিয়মিত মাসিক নিয়মিত করার উপায় নিয়ে আলোচনা করবো।
পিরিয়ড নিয়মিত করার ১০টি উপায়:
পিরিয়ড নিয়মিত
না হওয়া অনেক নারীর জন্য একটি সাধারণ সমস্যা। বিভিন্ন কারণ যেমন হরমোনের সমস্যা, ওজন বৃদ্ধি বা হ্রাস, মানসিক চাপ, এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তনের জন্য পিরিয়ড অনিয়মিত হতে
পারে। মাসিক নিয়মিত রাখার জন্য কিছু সাধারণ উপায় নিচে দেওয়া হলো:
১. পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ:
পিরিয়ড নিয়মিত রাখতে পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্বাস্থ্যকর ও সুষম খাদ্য শরীরের হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে, যা মাসিক চক্রের নিয়মিততা নিশ্চিত করতে সহায়ক। মাসিকের সময় রক্তের ক্ষরণ হয়, তাই আয়রন সমৃদ্ধ খাবার যেমন পালং শাক, লাল শাক, কলিজা, মটরশুটি, ডাল ইত্যাদি গ্রহণ করা জরুরি।
ডিম, মাংস, মাছ, বাদাম এবং ডাল প্রোটিন সরবরাহ করে, যা শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ভিটামিন সি আয়রন
শোষণে সাহায্য করে। লেবু, আমলকী, কমলা ইত্যাদি ভিটামিন সি এর ভালো উৎস। তাজা ফল ও সবজি
ভিটামিন, মিনারেল এবং ফাইবার সরবরাহ করে, যা হজম ভালো রাখে এবং শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
এসব পুষ্টিকর খাবার নিয়মিত গ্রহণ করলে হরমোনের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে
এবং পিরিয়ড চক্র নিয়মিত হতে পারে।
২. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা:
পিরিয়ড চক্র
নিয়মিত রাখতে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অতিরিক্ত বা অত্যন্ত কম
ওজন, উভয় ক্ষেত্রেই হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত
হতে পারে, যা মাসিকের অনিয়মিত হওয়ার প্রধান
কারণগুলোর একটি। ওজন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শরীরের হরমোন ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব, যা মাসিকের সময়সূচি নিয়মিত রাখে।
পুষ্টিকর
খাবার যেমন ফল, সবজি, প্রোটিন এবং ভালো ফ্যাট গ্রহণ করে সঠিক ডায়েট বজায়
রাখা উচিত। অস্বাস্থ্যকর, চর্বিযুক্ত, ফাস্টফুড,
কোমল পানীয় বা
প্রক্রিয়াজাত খাবার যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। কারণ এই সব খাবারের দ্বারা
শরীরে ওজন বাড়ে এবং হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে পিরিয়ড অনিয়মিত হয়ে যায়।
৩. নিয়মিত ব্যায়াম করা:
পিরিয়ড নিয়মিত
রাখতে নিয়মিত ব্যায়াম অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে। ব্যায়াম শরীরের হরমোন
উৎপাদন এবং নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে,
যা মাসিক চক্র
নিয়মিত রাখতে সহায়ক। এটি ইনসুলিনের কার্যকারিতা উন্নত করে এবং শরীরের অন্যান্য
হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। ব্যায়াম মানসিক চাপ বা স্ট্রেস কমাতে
সাহায্য করে, যা মাসিক চক্রকে
প্রভাবিত করতে পারে। ব্যায়াম এন্ডোরফিন নামক "হ্যাপি হরমোন" নিঃসরণ করে, যা মনের স্বস্তি আনে।
ওজন বাড়া বা
কমে যাওয়া পিরিয়ড চক্রের অনিয়মের কারণ হতে পারে। নিয়মিত ব্যায়াম ওজন নিয়ন্ত্রণে
রাখতে সহায়ক, যা মাসিক চক্রকে
স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে। প্রতিদিন ৩০ মিনিটের হালকা হাঁটাহাঁটি বা দৌড়ানো
শরীরকে সক্রিয় রাখে। যোগব্যায়াম মাসিক চক্র নিয়মিত করতে এবং হরমোনের ভারসাম্য
বজায় রাখতে খুবই সহায়ক। সাঁতার একটি সম্পূর্ণ ব্যায়াম, যা শরীরের সব অংশের জন্য কার্যকর, ফলে পিরিয়ড নিয়মিত করার জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
৪. হাইড্রেটেড থাকা:
মাসিক চক্র
নিয়মিত রাখতে হাইড্রেটেড থাকা, অর্থাৎ পর্যাপ্ত পানি
পান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পানি শরীরের নানা প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
পালন করে এবং হরমোন ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক, যা মাসিক
নিয়মিত রাখার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। পর্যাপ্ত পানি শরীর থেকে টক্সিন বা
বিষাক্ত পদার্থ দূর করতে সহায়তা করে। এই প্রক্রিয়া হরমোনগুলোর সুস্থ কার্যকারিতা
বজায় রাখতে সহায়ক এবং পিরিয়ড চক্র নিয়মিত রাখতে ভূমিকা রাখে।
হাইড্রেটেড
থাকা হজম প্রক্রিয়া ভালো রাখে, যা পুরো শরীরের জন্য
উপকারী এবং পুষ্টি শোষণ উন্নত করতে সহায়ক। পুষ্টি শোষণ ঠিক থাকলে মাসিক চক্র
নিয়মিত থাকে। প্রত্যেক নারীর প্রতিদিন কমপক্ষে ৮-১০ গ্লাস পানি পান করা উচিত।
পানিতে লেবুর রস বা শসার টুকরো মিশিয়ে পান করলে তা আরও রিফ্রেশিং হতে পারে।
ক্যাফেইন সমৃদ্ধ পানীয় এড়িয়ে চলুন,
কারণ তা
পানিশূন্যতার কারণ হতে পারে, যার ফলে পিরিয়ড অনিয়মিত
হয়ে যেতে পারে।
৫. পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা:
পিরিয়ড নিয়মিত
রাখতে পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঘুম শরীরের বিভিন্ন হরমোনের
ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে, যা মাসিক চক্রকে
প্রভাবিত করে। ঘুমের অভাব হরমোনের কার্যক্রমকে বিঘ্নিত করতে পারে, ফলে পিরিয়ড অনিয়মিত হতে পারে। ঘুমের অভাব মানসিক চাপ
বাড়ায়, যা কোর্টিসল (স্ট্রেস হরমোন) উৎপাদন
বাড়ায়। উচ্চ স্তরের কোর্টিসল মাসিক চক্রের অনিয়মের একটি প্রধান কারণ হতে পারে।
প্রতিদিন একই
সময়ে শোয়া এবং ওঠার অভ্যাস গড়ে তুলুন। ঘুমের আগে ফোন বা ট্যাবলেট ব্যবহার করা
থেকে বিরত থাকুন। এই গ্যাজেটগুলো থেকে নির্গত নীল আলো মেলাটোনিন উৎপাদন কমিয়ে
দেয়। ঘুমানোর ঘরটি শান্ত, অন্ধকার এবং শীতল
রাখুন। আরামদায়ক বিছানা এবং বালিশ ব্যবহার করুন। ঘুমানোর আগে হালকা বই পড়া, ধ্যান বা শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করতে পারেন।
৬. মানসিক চাপ কমানো:
পিরিয়ড নিয়মিত
রাখতে মানসিক চাপ কমানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক চাপ শরীরের হরমোন ভারসাম্যে
নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, যা মাসিক চক্রের
অনিয়মিত হওয়ার প্রধান কারণগুলোর একটি। চাপ বাড়লে শরীর কোর্টিসল হরমোনের উৎপাদন
বাড়ায়, যা প্রজনন হরমোনের ভারসাম্যকে বিঘ্নিত করে।
মানসিক চাপ কমালে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং
অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। ভালো শারীরিক স্বাস্থ্য মাসিক
নিয়মিত রাখতে সহায়ক।
মানসিক চাপ
কমানো মেজাজের ওঠানামা কমাতে সহায়ক,
যা মাসিকের
সময় অনেকের মধ্যে অনুভূত হয়। প্রতিদিন কিছু সময় ধ্যান বা যোগব্যায়াম করুন। এটি
মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে এবং মনের শান্তি আনে। পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে সময়
কাটানো মানসিক চাপ কমায়। তারা আপনাকে সমর্থন ও উৎসাহিত করে। দৈনিক কাজের চাপ থেকে
কিছু সময় বিশ্রাম নিন। ভালোভাবে বিশ্রাম নেওয়া এবং শখের কাজগুলো করা মানসিক চাপ
কমাতে সাহায্য করে।
৭. ইনসুলিন নিয়ন্ত্রণ করা:
পিরিয়ড নিয়মিত
রাখতে ইনসুলিন নিয়ন্ত্রণ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। ইনসুলিন শরীরের গ্লুকোজ
ব্যবহারে এবং সঞ্চয়ে প্রধান ভূমিকা পালন করে, এবং এর মাত্রা
বেড়ে গেলে এটি হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত করতে পারে, যা মাসিক
চক্রের অনিয়মিত হওয়ার কারণ হতে পারে। বিশেষ করে পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (PCOS) আক্রান্ত মহিলাদের জন্য ইনসুলিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ
অপরিহার্য।
অপ্রক্রিয়াজাত
খাবার, ফলমূল, সবজি এবং
প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করুন, যা ইনসুলিনের মাত্রা
স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে। ইনসুলিন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে শরীরের হরমোনের
ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হয়, যা পিরিয়ড চক্রকে
নিয়মিত রাখতে সহায়ক। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং খাদ্যাভ্যাস পালন করা ইনসুলিন
নিয়ন্ত্রণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৮. হরমোন থেরাপি নেয়া:
পিরিয়ড নিয়মিত
রাখতে হরমোন থেরাপি অনেক সময় কার্যকর হতে পারে, বিশেষ করে
যারা মাসিক চক্রের অস্বাভাবিকতা বা সমস্যা, যেমন
পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (PCOS) বা অন্যান্য হরমোনজনিত
সমস্যায় ভুগছেন তাদের জন্য। হরমোন থেরাপি হরমোনের স্তরকে সমন্বয় করতে এবং
মাসিকের নিয়মিততা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করতে পারে।
অনেক ক্ষেত্রে, হরমোন থেরাপি পিরিয়ডের সময় ব্যথা এবং অস্বস্তি কমাতে
সাহায্য করে। হরমোন থেরাপি পিরিয়ড নিয়মিত করার একটি কার্যকর উপায় হতে পারে, তবে এটি ব্যবহার করার আগে সব দিক বিবেচনা করা এবং
ডাক্তারি পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
৯. হার্বাল চা পান করা:
মাসিক নিয়মিত
রাখতে হার্বাল চা পান করা একটি সহায়ক এবং প্রাকৃতিক উপায় হতে পারে। কিছু হার্বাল
চা বিশেষভাবে মাসিক চক্রকে সমর্থন করতে এবং মাসিক ব্যথা ও অস্বস্তি কমাতে সহায়ক।
কিছু হার্বাল চা, যেমন রেড ক্লোভার এবং
শ্বাসনিক, শরীরে ইস্ট্রোজেনের স্তর বাড়াতে সহায়ক, যা পিরিয়ড নিয়মিত করতে সাহায্য করে।
ক্যামোমাইল চা
মানসিক চাপ কমাতে এবং ঘুমের গুণমান বাড়াতে সহায়ক। এটি মাসিকের সময় ব্যথা কমাতে
সাহায্য করে। জিঞ্জার চা অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি এবং পেটের সমস্যা কমাতে সহায়ক।
মাসিকের সময় খিঁচুনি কমাতে এটি কার্যকর। পিপারমিন্ট চা পেটের ব্যথা এবং ফোলাভাব
কমাতে সাহায্য করে এবং শিথিল হতে সহায়ক।
১০. ডাক্তারি পরামর্শ নেয়া:
পিরিয়ড নিয়মিত
রাখতে ডাক্তারি পরামর্শ নেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বিশেষ করে যদি আপনি পিরিয়ড চক্রে অনিয়মিততা, অতিরিক্ত ব্যথা, বা অন্যান্য সমস্যায় ভুগে থাকেন। ডাক্তারি পরামর্শের
মাধ্যমে আপনি সঠিক তথ্য এবং চিকিৎসা পেতে পারেন, যা আপনার
শারীরিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে উপযুক্ত হবে।
আপনার মাসিক
চক্রের অনিয়ম, ব্যথা, বা অন্যান্য সমস্যা সম্পর্কে বিস্তারিত চিকিৎসককে জানান।
ডাক্তার পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু পরীক্ষা করতে বললে প্রস্তুত থাকুন।
ডাক্তারি পরামর্শ গ্রহণের পাশাপাশি নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ। এটি আপনার সামগ্রিক স্বাস্থ্য এবং মাসিক চক্রের স্বাস্থ্যের উপর নজর
রাখতে সাহায্য করবে।
কোন মন্তব্য নেই