কিডনিতে পাথর হওয়ার প্রধান ১০টি কারণ !
কিডনি হলো মানবদেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যা রক্ত পরিশোধন করে শরীর থেকে বর্জ্য পদার্থ অপসারণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মানুষের শরীরে সাধারণত দুটি কিডনি থাকে, যা পিঠের নিচের দিকে মেরুদণ্ডের উভয় পাশে অবস্থিত। কিডনি রক্ত থেকে অতিরিক্ত পানি, লবণ, এবং বর্জ্য পদার্থ ফিল্টার করে, যা পরে মূত্র হিসেবে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। কিডনিতে পাথর পড়া একটি সাধারণ সমস্যা। আজকের আলোচনায় আমরা কিডনিতে পাথর হওয়ার কারণ সমূহ জানার চেষ্টা করবো।
কিডনিতে পাথর হওয়ার কারণ:
কিডনির পাথর হলো ছোট, কঠিন খনিজ ও লবণের স্ফটিকসমূহ, যা কিডনিতে তৈরি হয়। এটি তখনই গঠিত হয় যখন মূত্রের মধ্যে থাকা খনিজ ও অন্যান্য পদার্থ একত্রিত হয়ে কঠিন আকার ধারণ করে। কিডনির পাথরের আকার ছোট থেকে বড় হতে পারে এবং এগুলো কখনো কখনো মূত্রনালিতে আটকে গিয়ে প্রচণ্ড ব্যথার সৃষ্টি করতে পারে। কিডনিতে পাথর পড়ার প্রধান কারণ সমূহ নিম্নে বর্ণনা করা হলো।
১. পর্যাপ্ত পানি না খাওয়া:
কিডনিতে পাথর পড়ার একটি প্রধান কারণ পর্যাপ্ত পানি না খাওয়া। যখন শরীরে পর্যাপ্ত পানি থাকে না, তখন মূত্র ঘন হয়ে যায় এবং এতে বিভিন্ন খনিজ যেমন ক্যালসিয়াম,
অক্সালেট ও ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে যায়। এই অতিরিক্ত খনিজগুলো একত্রিত হয়ে কিডনিতে স্ফটিক বা কঠিন পাথরের মতো জমা হতে শুরু করে। অতিরিক্ত ঘন মূত্রে সঠিকভাবে খনিজ দ্রবীভূত হতে পারে না, যা পাথর তৈরির প্রধান কারণগুলোর মধ্যে একটি। পর্যাপ্ত পানি পান করলে এই খনিজ পদার্থগুলো
সহজেই প্রস্রাবের মাধ্যমে বেরিয়ে যেতে পারে এবং পাথর তৈরির ঝুঁকি কমে। কিডনি সুস্থ রাখতে এবং পাথর প্রতিরোধ করতে দৈনিক ৮-১০ গ্লাস বা প্রায় ২-৩ লিটার পানি পান করা উচিৎ। তবে, ব্যায়াম করলে বা গরম আবহাওয়ায়
পানি আরও বেশি প্রয়োজন হতে পারে।
২. অতিরিক্ত লবণ খাওয়া:
অতিরিক্ত লবণ খাওয়াও কিডনিতে পাথর পড়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। লবণ বা সোডিয়ামের অতিরিক্ত গ্রহণ শরীরে ক্যালসিয়ামের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা কিডনি স্টোন তৈরির ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। লবণ বেশি খেলে কিডনি মূত্রের মাধ্যমে ক্যালসিয়াম
নির্গমন বাড়িয়ে দেয়, যা পরে অক্সালেট ও অন্যান্য খনিজের সঙ্গে মিলে স্ফটিক বা পাথর তৈরি করে। বেশি লবণ খেলে উচ্চ রক্তচাপ হয়, যা কিডনির ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে এবং কিডনির কার্যক্ষমতা হ্রাস করে। বেশি লবণ খেলে শরীরে পানির চাহিদা বেড়ে যায়, ফলে পর্যাপ্ত পানি না পান করলে মূত্র ঘন করে তোলে এবং পাথর তৈরির ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেয়।
৩. অতিরিক্ত প্রাণীজ প্রোটিন গ্রহণ:
কিডনিতে পাথর পড়ার একটি কারণ হলো অতিরিক্ত প্রাণীজ প্রোটিন গ্রহণ। প্রাণীজ প্রোটিন যেমন মাংস, মাছ, ডিম এবং দুগ্ধজাত পণ্য শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বৃদ্ধি করে, যা কিডনিতে ইউরিক অ্যাসিড স্টোন তৈরির ঝুঁকি বাড়ায়। অতিরিক্ত প্রাণীজ প্রোটিন ক্যালসিয়ামের পরিমাণকেও প্রভাবিত করে, যা ক্যালসিয়াম
অক্সালেট স্টোন তৈরিতে সহায়ক হতে পারে। প্রাণীজ প্রোটিনের অতিরিক্ত গ্রহণ শরীরে অ্যাসিডের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা কিডনির কার্যক্ষমতা কমিয়ে কিডনি স্টোন তৈরিতে ভূমিকা রাখে।
৪. অক্সালেটযুক্ত খাবার গ্রহণ:
অক্সালেটযুক্ত খাবার কিডনিতে পাথর হওয়ার একটি কারণ হতে পারে। অক্সালেট হলো এক ধরনের প্রাকৃতিক
যৌগ, যা কিছু খাবারে পাওয়া যায়। যখন শরীরে অক্সালেটের
মাত্রা বেশি হয়ে যায় এবং এটি ক্যালসিয়ামের সঙ্গে মিলে যায়, তখন ক্যালসিয়াম
অক্সালেট স্ফটিক তৈরি হয়, যা কিডনিতে জমা হয়ে পাথর তৈরি করতে পারে। পালং শাক, বিট কপি, বাদাম, আলু, চকলেট, এবং চায়ে উচ্চমাত্রায় অক্সালেট থাকে। নিয়মিত এ ধরনের খাবার অতিরিক্ত পরিমাণে খেলে অক্সালেটের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা পাথর তৈরির ঝুঁকি বাড়ায়।
৫. পারিবারিক ইতিহাস:
কিডনিতে পাথর হওয়ার একটি কারণ হলো জেনেটিক বা পারিবারিক
ইতিহাস। যদি পরিবারের কোনো সদস্যের কিডনিতে পাথর হওয়ার ইতিহাস থাকে, তাহলে সেই পরিবারের অন্য সদস্যদেরও
পাথর হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। জেনেটিক কারণে শরীরে এমন কিছু পরিবর্তন ঘটে যা কিডনির কার্যপ্রণালীকে প্রভাবিত করে এবং পাথর তৈরির ঝুঁকি বাড়ায়। কিছু মানুষের শরীরে বংশগত কারণে ক্যালসিয়াম,
অক্সালেট বা ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেশি থাকে, যা সহজে কিডনিতে পাথর তৈরি করে। রেনাল টিউবুলার এসিডোসিস একটি জেনেটিক কিডনি সমস্যা, যা কিডনিতে অ্যাসিড নিঃসরণের সমস্যা তৈরি করে এবং পাথর তৈরির ঝুঁকি বাড়ায়। সিস্টিনুরিয়া একটি বংশগত সমস্যা, যেখানে মূত্রে সিস্টিন নামে একটি অ্যামিনো অ্যাসিডের অতিরিক্ত নিঃসরণ ঘটে, যা সিস্টিন পাথর তৈরির কারণ হতে পারে।
৬. অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম
সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ:
অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট
গ্রহণও কিডনিতে পাথর হওয়ার একটি কারণ হতে পারে। ক্যালসিয়াম
সাপ্লিমেন্ট বেশি পরিমাণে গ্রহণ করলে শরীরে ক্যালসিয়ামের মাত্রা বেড়ে যায়, যা অক্সালেটের
সঙ্গে মিলে ক্যালসিয়াম
অক্সালেট স্ফটিক তৈরি করতে পারে। এই স্ফটিকগুলো
কিডনিতে জমা হয়ে পাথর তৈরি করে। যাদের ক্যালসিয়ামের ঘাটতি নেই, তাদের জন্য ক্যালসিয়াম
সাপ্লিমেন্ট নেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ
হতে পারে। ক্যালসিয়াম
সাপ্লিমেন্ট শরীরে অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম সরবরাহ করে, যা মূত্রের মাধ্যমে বের হওয়ার চেষ্টা করে। এতে মূত্রে ক্যালসিয়ামের মাত্রা বেড়ে যায়, যা অক্সালেটের
সঙ্গে মিলে কিডনিতে ক্যালসিয়াম অক্সালেট পাথর তৈরি করতে পারে। ক্যালসিয়ামের সঙ্গে অতিরিক্ত ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট
গ্রহণ ক্যালসিয়ামের শোষণ আরও বাড়ায়, যা কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
৭. অতিরিক্ত ওষুধ গ্রহণ:
অতিরিক্ত ওষুধ গ্রহণও কিডনিতে পাথর হওয়ার একটি কারণ হতে পারে। কিছু ওষুধ কিডনির কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে এবং শরীরে খনিজ ও পদার্থের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে, যা পরে কিডনিতে পাথর তৈরির ঝুঁকি বাড়ায়। মূত্রবর্ধক
ঔষধ সেবন করলে এই ঔষুধগুলি শরীর থেকে অতিরিক্ত পানি এবং সোডিয়াম বের করতে সহায়ক, তবে এগুলি ক্যালসিয়ামের নিঃসরণ বাড়িয়ে দিতে পারে, যা কিডনিতে ক্যালসিয়াম
অক্সালেট পাথর তৈরির আশংকা বৃদ্ধি করে। বিশেষ কিছু অ্যান্টিবায়োটিকস যেমন সিফালোস্পোরিনস ও টেট্রাসাইক্লিনের মতো কিছু অ্যান্টিবায়োটিক দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহারে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়াতে পারে, যা ইউরিক অ্যাসিড পাথর তৈরির সম্ভাবনা বাড়ায়। অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট
এবং ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের ফলে ক্যালসিয়ামের শোষণ বাড়ে, যা পরে কিডনিতে পাথর তৈরির আশংকা তৈরি করে। কিছু পেইন রিলিভার ওষুধ, দীর্ঘমেয়াদী
ব্যবহারের ফলে কিডনির কার্যক্ষমতাকে প্রভাবিত করে এবং পাথর তৈরির ঝুঁকি বাড়ায়।
৮. মূত্রনালীর সংক্রমণ:
মূত্রনালীর
সংক্রমণ বা Urinary Tract Infection (UTI) কিডনিতে পাথর পড়ার একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে। সংক্রমণের ফলে মূত্রপথে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন ঘটে, যা কিডনিতে পাথর তৈরির ঝুঁকি বাড়ায়। সংক্রমণজনিত
কারণে শরীরের জলশূন্যতা
সৃষ্টি হলে মূত্র ঘন হয়ে যায়, যা কিডনিতে স্ফটিক বা পাথর তৈরির আশংকা বাড়ায়। সংক্রমণের
কারণে শরীরে ক্যালসিয়াম
এবং ইউরিক অ্যাসিডের
স্তর বেড়ে যেতে পারে, যা কিডনিতে পাথর তৈরি করার জন্য একটি ভূমিকা পালন করতে পারে। সংক্রমণের ফলে মূত্রের পিএইচ স্তরের পরিবর্তন হতে পারে, যা কিডনিতে পাথর তৈরি করার আশংকাকে বাড়ায়ে দিতে পারে।
৯. ওজন বৃদ্ধি ও স্থূলতা:
কিডনিতে পাথর পড়ার একটি কারণ হলো ওজন বৃদ্ধি ও স্থূলতা। অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা শরীরে বিভিন্ন ধরণের পরিবর্তন ঘটায়, যা কিডনির পাথর তৈরির ঝুঁকি বাড়াতে পারে। স্থূলতা শরীরে মেটাবলিজমের
পরিবর্তন ঘটায়, যা ক্যালসিয়াম, অক্সালেট ও ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়াতে পারে। এই পদার্থগুলো
কিডনিতে স্ফটিক বা পাথর তৈরি করার জন্য দায়ী। স্থূলতা ইনসুলিনের কার্যকারিতা
হ্রাস করে, যা কিডনির স্বাস্থ্যকে
প্রভাবিত করতে পারে এবং কিডনিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ায়। স্থূলতা সাধারণত স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের অভাব নির্দেশ করে, যার ফলে অতিরিক্ত লবণ এবং প্রাণীজ প্রোটিনের গ্রহণ বেড়ে যায়। এই দুটোই কিডনিতে পাথর তৈরির ঝুঁকি বাড়ায়।
১০. হাইপারপারাথাইরয়েডিজম:
হাইপারপারাথাইরয়েডিজম Hyperparathyroidism কিডনিতে পাথর পড়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। এটি একটি শারীরবৃত্তীয় অবস্থা যেখানে প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থি অতিরিক্ত প্যারাথাইরয়েড হরমোন (PTH) উৎপাদন করে। এই হরমোনের বাড়তি মাত্রা কিডনিতে পাথর তৈরির জন্য কিছু প্রক্রিয়া
সৃষ্টি করে। হাইপারপারাথাইরয়েডিজম কিডনির কার্যক্ষমতা প্রভাবিত করে, যার ফলে মূত্রের পিএইচ স্তর পরিবর্তিত হতে পারে। এই পরিবর্তন কিডনিতে পাথর তৈরির আশংকা বাড়ায়।
পানি পান মূত্রকে সঠিকভাবে হাইড্রেটেড রাখে এবং পেট হতে খনিজগুলো সহজে বের হতে সাহায্য করে। কিডনিকে সুস্থ্য রাখতে পানি পানের কোনও বিকল্প নেই। তাই আমাদের উচিত প্রতিদিন অন্তত: ২ লিটার পানি পান করা।
কোন মন্তব্য নেই