মেলানোমা কী? কারণ, মেলানোমার লক্ষণ এবং যেখানে হয়
ক্যানসার একটি জটিল সমস্যা। এটির বিভিন্ন শ্রেনীবিভাগ রয়েছে, যার মধ্যে স্কিন ক্যানসার অন্যতম। চামড়া বা স্কিন ক্যানসারের একটি প্রকার মেলানোমা। এটি সাধারণত ফর্সা মানষের চামড়ায় বেশি হয়, তবে কালো চামড়ায়ও আশংকাজনক ভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে। আজকের আলোচনায় আমরা মেলানোমার পরিচয় এবং ক্যানসারের বিস্তার সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো।
মেলানোমা কী?
মেলানোমা (Melanoma) হলো এক ধরনের ত্বকের ক্যানসার, যা মেলানোসাইট নামক কোষ থেকে শুরু হয়। মেলানোসাইট কোষ ত্বকের রঙ উৎপন্ন করে এবং এটি মেলানিন নামক পিগমেন্ট তৈরি করে। মেলানোমা সাধারণত ত্বকে কালো বা বাদামী দাগের আকারে দেখা যায় এবং সময়ের সাথে সাথে আকারে ও রঙে পরিবর্তিত হতে পারে। মেলানোমা মূলত অতিবেগুনি রশ্মি (UV) দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতির কারণে হয়, যা সূর্যালোক বা সানবেডের মতো কৃত্রিম UV উৎস থেকেও আসতে পারে।
মেলানোমা
কোথায় হয়?
মেলানোমা সাধারণত ত্বকে দেখা যায়, তবে এটি শরীরের বিভিন্ন স্থানে হতে পারে। সাধারণত যেসব অংশে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির সংস্পর্শ বেশি হয়, যেমন মুখ, ঘাড়, বাহু, পিঠ ও পা, সেখানে মেলানোমা বেশি দেখা যায়। তবে মেলানোমা শরীরের অভ্যন্তরীণ অংশেও হতে পারে, যেমন:
• চোখে: মেলানোমা চোখে
হলে তাকে অকুলার বা ইউভিয়াল মেলানোমা বলা হয়।
• নাক, মুখ, গলা, ও পাকস্থলী: এই ধরনের স্থানে হলে তাকে মিউকোসাল মেলানোমা
বলা হয়।
• মস্তিষ্ক, লিভার, ফুসফুস, এবং হাড়: মেলানোমা মস্তিষ্ক, লিভার, ফুসফুস, এবং হাড়ে ছড়াতে পারে যদি এটি শরীরের অন্যান্য স্থানেও
ছড়িয়ে থাকে।
মেলানোমা হওয়ার কারণ:
মেলানোমা এক
ধরণের ত্বকের ক্যান্সার, যা মেলানিন উৎপাদনকারী
কোষ বা মেলানোসাইট থেকে তৈরি হয়। এটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ত্বকের উপর গাঢ় রঙের
ফোঁটা, মোল বা জন্মচিহ্নের মত দেখতে হয় এবং এগুলো
দ্রুত বৃদ্ধি পায়। মেলানোমার প্রধান কারণগুলির মধ্যে রয়েছে:
সূর্যের
অতিবেগুনী (UV) রশ্মি: সূর্যের
অতিবেগুনী রশ্মি ত্বকের কোষের ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, যা মেলানোমার একটি প্রধান কারণ। যারা অধিক সময় ধরে
সূর্যের তাপ বা সানবার্নে আক্রান্ত হন তাদের মেলানোমার ঝুঁকি বেশি থাকে। বিশেষ করে
যারা রোদে দীর্ঘ সময় কাজ করে কিংবা রোদে অবস্থান করে।
সানবার্ন:
জীবনে এক বা একাধিকবার গুরুতর সানবার্ন হওয়া মেলানোমার ঝুঁকি বাড়াতে পারে। সূর্যের
আলো শরীরে দীর্ঘ সময় লেগে যদি ত্বক লাল হয়ে যায় বা ফোস্কা পড়ে তাহলে মেলানোমা
হওয়ার ঝঁকি বেড়ে যায়।
অতিরিক্ত সান ট্যানিং: সান ট্যানিং বা কৃত্রিম সূর্যের আলোর উৎস যেমন ট্যানিং বেডও মেলানোমার কারণ হতে পারে, কারণ এগুলোও ত্বকে অতিবেগুনী রশ্মি প্রয়োগ করে। অনেকে ট্যানিং বেড ব্যবহার করেন, যেগুলো স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
জেনেটিক কারণ:
মেলানোমার ঝুঁকি পারিবারিক ইতিহাসের ওপর নির্ভর করতে পারে। যদি পরিবারের মধ্যে
কারও মেলানোমা থাকে তবে অন্যান্য সদস্যেরও এর ঝুঁকি থাকে। বিশেষ করে যদি পিতা মাতা
কারও মেলানোমা থাকে তবে সন্তানদেরও মেলানোমা হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
হালকা ত্বক:
যাদের ত্বক হালকা বা শ্বেতাঙ্গ, লাল বা সোনালী চুল এবং
নীল চোখ আছে, তাদের মেলানোমার ঝুঁকি
বেশি থাকে কারণ তাদের ত্বকে মেলানিনের পরিমাণ কম থাকে, যা UV রশ্মি থেকে ত্বককে
রক্ষা করতে পারে।
অন্যান্য
ত্বকের সমস্যা: অতীতে যারা অন্য কোন ত্বকের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন বা ত্বকে
অস্বাভাবিক জন্মচিহ্ন বা মোল রয়েছে তাদেরও মেলানোমা হওয়ার আশংকা থাকে। একবার স্কিন
ক্যান্সরা হলে দ্বিতীয়বারও ক্যান্সার হওয়ার ভয় থাকে।
মেলানোমার লক্ষণ:
মেলানোমা
চিহ্নিত করতে সাধারণত "ABCDE"
নিয়ম অনুসরণ
করা হয়, যা বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে মেলানোমার
লক্ষণগুলো সনাক্ত করতে সাহায্য করে:
১. A - Asymmetry (অসামঞ্জস্য): মেলানোমা হলে ত্বকের ফোঁটার
দুই পাশে মিল থাকে না, অর্থাৎ একপাশ আরেক
পাশের থেকে ভিন্ন দেখায়।
২. B - Border (সীমা): মেলানোমার সীমানা বা প্রান্তগুলো
অসমান, ঝাপসা, বা খাঁজকাটা
হতে পারে। সাধারণ মোল বা জন্মচিহ্নের প্রান্ত সমান ও মসৃণ হয়, তবে মেলানোমা এভাবে হয় না।
৩. C - Color (রঙ): মেলানোমার রঙ সাধারণত অমসৃণ হয় এবং
এতে একাধিক রঙ থাকে যেমন কালো, বাদামি, লাল, নীল বা সাদা।
৪. D - Diameter (ব্যাস): সাধারণত মেলানোমার ব্যাস ছয়
মিলিমিটার বা এর বেশি হয়, যা একটি পেন্সিলের
ইরেজারের সমান। তবে কিছু মেলানোমা এর চেয়ে ছোটও হতে পারে।
৫. E - Evolving (পরিবর্তনশীলতা): যদি কোনো মোল বা ফোঁটার
আকার, রঙ, আকার, বা অনুভূতিতে পরিবর্তন আসে, তবে এটি মেলানোমার লক্ষণ হতে পারে।
অন্যান্য
লক্ষণ:
- নতুন বা অস্বাভাবিক মোল বা ফোঁটা দেখা দিলে।
- ত্বকের মোলের আশপাশে চুলকানি, রক্তপাত, বা ব্যথা হলে।
- ত্বকে কালো, বাদামি বা লাল রঙের ছোট ছোট গুটির মতো ফোঁটা তৈরি হলে।
মেলানোমার
সন্দেহ হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ, কারণ প্রাথমিক পর্যায়ে সনাক্ত করা গেলে মেলানোমা
নিরাময় করা সহজ হয়।
মেলানোমার প্রকারভেদ:
মেলানোমা
ত্বকের বিভিন্ন স্তরে এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে দেখা দিতে পারে। এটি সাধারণত চার
ধরনের হয়, প্রতিটির নিজস্ব
বৈশিষ্ট্য এবং বৃদ্ধি পদ্ধতি রয়েছে,
যথা:
১. সারফেস
স্প্রেডিং মেলানোমা (Superficial
Spreading Melanoma):
এই ধরনের
মেলানোমা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এবং প্রাথমিক পর্যায়ে এটি ত্বকের উপরের স্তরে
ছড়ায়। সাধারণত এটি মোল বা গাঢ় চিহ্নের মতো শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে চারপাশে
ছড়ায়। এটি শরীরের যেকোনো স্থানে হতে পারে, তবে পিঠ, পা, হাত, বা মুখে বেশি দেখা যায়।
২. নোডুলার
মেলানোমা (Nodular Melanoma):
এটি একটি
অত্যন্ত আক্রমণাত্মক ধরনের মেলানোমা যা দ্রুত গভীরে প্রবেশ করতে পারে। সাধারণত এটি
গাঢ় কালো বা নীল রঙের হয় এবং মোলের মতো দেখতে হতে পারে, তবে কখনও কখনও এটি লাল বা বর্ণহীনও হতে পারে। এটি দ্রুত
বাড়তে পারে এবং দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন।
৩. লেনটিগো
ম্যালিগনা মেলানোমা (Lentigo
Maligna Melanoma):
এই ধরনের
মেলানোমা সাধারণত বয়স্কদের মধ্যে বেশি দেখা যায় এবং মুখ, কাঁধ বা ঘাড়ে সূর্যের আলো বেশি পড়া অংশে বেশি দেখা
যায়। এটি দীর্ঘ সময় ধরে বৃদ্ধি পায় এবং মোল বা চিহ্নের মতো দেখতে হতে পারে যা
আকারে বাড়তে থাকে। এটি ধীরে ধীরে ত্বকের গভীরে প্রবেশ করে।
৪. অ্যাক্রাল
লেন্টিজিনাস মেলানোমা (Acral
Lentiginous Melanoma):
এই ধরনের
মেলানোমা হাতের তালু, পায়ের তলা এবং নখের
নিচে দেখা যায়। এটি তুলনামূলকভাবে বিরল এবং সাধারণত গাঢ় রঙের দাগ বা রেখার মতো
শুরু হয়। এই ধরনের মেলানোমা অশ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীতে বেশি দেখা যায়।
মেলানোমার অন্যান্য প্রকারভেদ:
• মিউকোজাল মেলানোমা (Mucosal Melanoma): এটি শরীরের অভ্যন্তরীণ মিউকাস মেমব্রেনের
মধ্যে ঘটে, যেমন মুখগহ্বর, নাক, মলদ্বার বা যোনিপথে।
• অকুলার মেলানোমা (Ocular Melanoma): এটি চোখের ভেতরে হয়, বিশেষত চোখের ইউভিয়া নামক অংশে, এবং এটি চোখের দৃষ্টিশক্তিতে প্রভাব ফেলতে পারে।
প্রাথমিক
পর্যায়ে মেলানোমা সনাক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি
দ্রুত শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যে কোনো অস্বাভাবিক মোল বা ত্বকের পরিবর্তন দেখা
দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
কিভাবে মেলানোমা প্রতিরোধ করা যায়:
মেলানোমা
প্রতিরোধের জন্য কিছু কার্যকর পদ্ধতি অনুসরণ করা যায় যা ত্বকের ক্যান্সারের ঝুঁকি
হ্রাস করতে সাহায্য করতে পারে। সূর্যের অতিবেগুনী (UV) রশ্মি
মেলানোমার প্রধান কারণ, তাই ত্বককে সূর্যের
ক্ষতিকর রশ্মি থেকে রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিচে মেলানোমা প্রতিরোধের
কিছু কার্যকরী উপায় উল্লেখ করা হলো:
সূর্যের
ক্ষতিকর রশ্মি এড়িয়ে চলা:
• সূর্য যখন সবচেয়ে বেশি
তীব্র, অর্থাৎ সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টার মধ্যে, তখন সূর্য থেকে দূরে থাকা উচিত। এই সময়ে সূর্যের
অতিবেগুনী রশ্মির তীব্রতা সবচেয়ে বেশি থাকে, যা ত্বককে
ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
• ছায়ায় থাকুন বা ছাতা
ব্যবহার করুন। বিশেষ করে যদি বাইরে যেতে হয়, তাহলে গাছের
ছায়া বা ছাতার নিচে থাকার চেষ্টা করুন।
সানস্ক্রিন
ব্যবহার:
• বাইরে যাওয়ার আগে
ত্বকে সানস্ক্রিন লাগান। ৩০ SPF বা তার বেশি মানের
সানস্ক্রিন ব্যবহার করা উচিত। এতে ত্বক অতিবেগুনী রশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে
কিছুটা সুরক্ষিত থাকে।
• সানস্ক্রিনের যথাযথ
প্রয়োগ গুরুত্বপূর্ণ। অন্তত ১৫-৩০ মিনিট আগে সানস্ক্রিন লাগানো উচিত এবং প্রতি দুই
ঘণ্টা পরপর তা পুনরায় প্রয়োগ করতে হবে, বিশেষত সাঁতার
কাটার পর বা ঘাম হলে।
প্রতিরোধমূলক
পোশাক পরা:
• হালকা রঙের লম্বা
পোশাক পরুন যা ত্বককে ঢেকে রাখে। টুপিও ব্যবহার করা যেতে পারে, কারণ এটি মুখ ও ঘাড়কে সূর্যের তীব্র রশ্মি থেকে রক্ষা
করতে সাহায্য করে।
• UV সুরক্ষা প্রদানকারী
সানগ্লাস পরুন, যা চোখ ও চোখের
চারপাশের সংবেদনশীল ত্বককে সুরক্ষা দেয়।
সান ট্যানিং
এড়িয়ে চলা:
• কৃত্রিম সূর্যের আলোর
উৎস, যেমন ট্যানিং বেড, মেলানোমার ঝুঁকি বাড়ায় কারণ এতে অতিবেগুনী রশ্মি ব্যবহার
করা হয় যা ত্বকের কোষের জন্য ক্ষতিকর। তাই ট্যানিং বেড ব্যবহার থেকে বিরত থাকা
উচিত।
ত্বকের
পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ:
• নিয়মিত ত্বকের উপর নজর
রাখুন। কোনো মোল বা ফোঁটার রঙ, আকার, বা গঠন পরিবর্তন হলে তা নজরে রাখুন। মেলানোমা সাধারণত
অস্বাভাবিক মোলের মতো দেখায়, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে
বড় হতে থাকে। এমন কিছু লক্ষণ দেখলে দ্রুত ডার্মাটোলজিস্টের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
• বছরে অন্তত একবার
ডার্মাটোলজিস্টের কাছে গিয়ে ত্বকের পরীক্ষা করানো উচিত, বিশেষ করে যদি অতীতে ত্বকে কোনো অস্বাভাবিক মোল বা
ক্যান্সার জাতীয় সমস্যা থেকে থাকে।
একটি
স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ত্বকের স্বাস্থ্য উন্নত রাখতে সাহায্য করে। পর্যাপ্ত ঘুম, পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণ, এবং মানসিক
চাপ কমানো ত্বকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক। সঠিক যত্ন এবং নিয়মিত পরীক্ষা
মেলানোমার ঝুঁকি অনেকটাই হ্রাস করতে পারে।
কোন মন্তব্য নেই