মেনোপজ কী? কখন ও কাদের হয় এবং মেনোপজের লক্ষণ
মেনোপজ হল একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া যেখানে একজন মহিলার মাসিক ঋতুস্রাব স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এটি সাধারণত মহিলাদের বয়স ৪৫ থেকে ৫৫ বছরের মধ্যে ঘটে এবং এটি তখন হয় যখন ডিম্বাশয়গুলি পর্যাপ্ত হরমোন উৎপাদন বন্ধ করে দেয়।
মেনোপজ কী?
মেনোপজ (Menopause) হলো একটি প্রাকৃতিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া যেখানে একজন মহিলার মাসিক ঋতুস্রাব স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়, যা প্রজনন সক্ষমতার সমাপ্তি নির্দেশ করে। এটি তখন ঘটে যখন ডিম্বাশয়গুলি পর্যাপ্ত হরমোন বিশেষত ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন উৎপাদন বন্ধ করে দেয়, যার ফলে ডিম্বাণু উৎপাদন প্রক্রিয়াও বন্ধ হয়ে যায়।
মেনোপজ কখন হয়?
মেনোপজ
সাধারণত মহিলাদের মধ্যে ৪৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সে ঘটে। তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি ৪০ বছরের
আগেও হতে পারে, যাকে প্রি-ম্যাচিওর
মেনোপজ বলা হয়, বা ৫৫ বছরের পর হতে
পারে। মেনোপজ নিশ্চিতভাবে ঘটে তখন, যখন একটানা ১২ মাস
কোনো মাসিক ঋতুস্রাব না হয়।
মেনোপজ এর কারণ:
মেনোপজের
প্রধান কারণ হলো বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ডিম্বাশয়ের কার্যকারিতা কমে যাওয়া এবং
হরমোনের উৎপাদন হ্রাস। তবে এর কিছু নির্দিষ্ট কারণ আছে, যা নিচে উল্লেখ করা হলো:
বয়সজনিত
পরিবর্তন: মহিলাদের ডিম্বাশয়গুলি সাধারণত ৪৫-৫৫ বছর বয়সে ধীরে ধীরে ইস্ট্রোজেন ও
প্রোজেস্টেরন হরমোন উৎপাদন কমিয়ে দেয়। এ কারণেই মাসিক ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায়
এবং মেনোপজ ঘটে।
হিস্টেরেকটমি
বা সার্জারি: যদি কোনো কারণে ডিম্বাশয়গুলো সার্জারির মাধ্যমে সরিয়ে ফেলা হয়, তাহলে মেনোপজ দ্রুত ঘটে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে যদি
শুধু জরায়ু সরিয়ে ফেলা হয় এবং ডিম্বাশয় রেখে দেওয়া হয়, তাহলে স্বাভাবিক মেনোপজের সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে
পারে।
কেমোথেরাপি বা
রেডিয়েশন থেরাপি: ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত কেমোথেরাপি ও রেডিয়েশন
থেরাপি ডিম্বাশয়ের কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করতে পারে, যার ফলে মেনোপজ ত্বরান্বিত হতে পারে।
প্রি-ম্যাচিওর
ওভারিয়ান ইনসাফিসিয়েন্সি (POI): কিছু মহিলার ক্ষেত্রে, ৪০ বছরের আগেই ডিম্বাশয় কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে, যা প্রি-ম্যাচিওর মেনোপজ বা প্রি-ম্যাচিওর ওভারিয়ান
ইনসাফিসিয়েন্সি (POI) নামে পরিচিত। এটি
জেনেটিক ফ্যাক্টর, অটোইমিউন ডিজঅর্ডার, বা অন্যান্য অজানা কারণের জন্য ঘটতে পারে।
জেনেটিক
ফ্যাক্টর: পরিবারের ইতিহাসও মেনোপজের বয়স নির্ধারণে ভূমিকা রাখতে পারে। যদি
পরিবারের অন্য সদস্যদের মেনোপজ আগে ঘটে থাকে, তবে সেই
পরিবারের অন্যান্য মহিলাদেরও মেনোপজ আগে হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
এই কারণগুলোর
কারণে ডিম্বাশয়ের হরমোন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় এবং মাসিক ঋতুস্রাব চিরতরে বন্ধ
হয়ে যায়, যা মেনোপজের সূচনা
করে।
মেনোপজ এর লক্ষণ:
মেনোপজের
লক্ষণগুলো হরমোনের পরিবর্তনের কারণে বিভিন্নভাবে প্রকাশ পায়। এগুলো প্রতিটি
মহিলার ক্ষেত্রে আলাদা হতে পারে এবং তীব্রতা বা সময়কালও ভিন্ন হতে পারে। মেনোপজের
সাধারণ লক্ষণগুলো হলো:
শারীরিক লক্ষণ:
• গরম লাগা: হঠাৎ করে শরীরের উপরের অংশে তীব্র
গরম অনুভূতি হওয়া, যা কয়েক সেকেন্ড থেকে
কয়েক মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
• রাতের ঘাম: রাতে অতিরিক্ত ঘাম হওয়া, যা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
• ঘুমের সমস্যা: সহজে ঘুম না আসা বা ঘুম ভেঙে
যাওয়া।
• হৃদস্পন্দনের পরিবর্তন: হৃদপিণ্ডের দ্রুত
স্পন্দন বা অনিয়মিত স্পন্দন।
• ওজন বৃদ্ধি: বিশেষ করে পেটের চারপাশে ওজন
বাড়তে পারে।
• যৌনাঙ্গের শুষ্কতা: যোনিপথের শুষ্কতা, যা যৌন সম্পর্কের সময় অস্বস্তি বা ব্যথা সৃষ্টি করতে
পারে।
• চুল পড়া ও ত্বকের পরিবর্তন: চুল পাতলা হয়ে যেতে পারে এবং ত্বক শুষ্ক ও নরম হয়ে যেতে পারে।
মানসিক লক্ষণ:
• মেজাজের পরিবর্তন: হরমোনের পরিবর্তনের কারণে
হতাশা, উদ্বেগ বা অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।
• মেমরি সমস্যা: মনোযোগে ঘাটতি বা
স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা হতে পারে।
• ইরিটেবিলিটি: ক্ষুব্ধ বা বিরক্ত হয়ে ওঠার
প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য প্রভাব:
• হাড়ের ঘনত্বের কমে যাওয়া (অস্টিওপরোসিস):
ইস্ট্রোজেনের মাত্রা কমে যাওয়ার কারণে হাড় দুর্বল হয়ে যেতে পারে।
• হৃদরোগের ঝুঁকি: মেনোপজের পর হৃদরোগের ঝুঁকি
বৃদ্ধি পেতে পারে।
অন্যান্য লক্ষণ:
• যৌন আগ্রহে পরিবর্তন: যৌন আগ্রহ বা লিবিডোতে
পরিবর্তন হতে পারে।
• ঠাণ্ডা লাগা: কিছু মহিলার ক্ষেত্রে বারবার
ঠাণ্ডা লাগার অনুভূতি হতে পারে।
এই লক্ষণগুলো
সময়ের সাথে সাথে কমে যেতে পারে, কিন্তু কিছু মহিলার
ক্ষেত্রে এই লক্ষণগুলো দীর্ঘ সময় ধরে থাকতে পারে।
কম বয়সে মেনোপজ ঠেকাতে করণীয়:
কম বয়সে
মেনোপজ (প্রি-ম্যাচিওর মেনোপজ) ঠেকানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে যা
স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতির উপর নির্ভর করে। যদিও
প্রি-ম্যাচিওর মেনোপজ পুরোপুরি রোধ করা সবসময় সম্ভব নয়, কিছু পরিবর্তন ও সতর্কতা তা বিলম্ব করতে সহায়ক হতে
পারে।
কম বয়সে
মেনোপজ ঠেকানোর জন্য করণীয়:
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা:
o ফল, সবজি, সুষম প্রোটিন, ওমেগা-৩
ফ্যাটি অ্যাসিড, এবং পূর্ণ শস্যযুক্ত
খাবার গ্রহণ করা উচিত।
o প্রক্রিয়াজাত খাবার, অতিরিক্ত চিনি ও ফ্যাট যুক্ত খাবার পরিহার করা ভালো।
o ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার খেলে
হাড় মজবুত থাকে এবং হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে।
নিয়মিত ব্যায়াম করা:
o নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম হরমোনের মাত্রা
স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করে এবং মেনোপজের লক্ষণগুলির তীব্রতা কমিয়ে আনে।
o যেমন: হাঁটা, যোগব্যায়াম, সাইক্লিং,
এবং হালকা
কার্ডিও ব্যায়াম।
ধূমপান এবং মদ্যপান এড়ানো:
o ধূমপান এবং অতিরিক্ত মদ্যপান প্রি-ম্যাচিওর
মেনোপজের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই এগুলো থেকে বিরত থাকলে মেনোপজ দেরিতে আসতে পারে।
মানসিক চাপ কমানো:
o মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও
দুশ্চিন্তা কমানোর জন্য মেডিটেশন, শ্বাস-প্রশ্বাসের
ব্যায়াম, এবং যোগব্যায়াম করতে পারেন।
o পর্যাপ্ত ঘুম এবং বিশ্রাম নেওয়া মানসিক
স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি (HRT):
o যদি প্রি-ম্যাচিওর মেনোপজের লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে একজন চিকিৎসকের পরামর্শে হরমোন রিপ্লেসমেন্ট
থেরাপি নেওয়া যেতে পারে। এটি ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের মাত্রা স্বাভাবিক করতে
সহায়তা করে এবং মেনোপজের লক্ষণগুলি কমিয়ে দেয়।
o এই থেরাপির সুবিধা এবং ঝুঁকি সম্পর্কে
ভালোভাবে বুঝে চিকিৎসকের নির্দেশ অনুসারে কাজ করা উচিত।
ওজন নিয়ন্ত্রণ করা:
o অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা মেনোপজের
লক্ষণগুলোকে তীব্র করে তুলতে পারে। তাই সুস্থ ওজন বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা:
o নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, বিশেষ করে হরমোনের মাত্রা চেক করা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ
গ্রহণ করা প্রয়োজন।
চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া:
যদি আপনি কম
বয়সে মেনোপজের লক্ষণগুলি অনুভব করেন বা আপনার পরিবারে প্রি-ম্যাচিওর মেনোপজের
ইতিহাস থাকে, তাহলে অবশ্যই একজন
চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। চিকিৎসা ও জীবনধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে মেনোপজের
সময়কাল বিলম্বিত করা যেতে পারে।
এই পদক্ষেপগুলো মেনে চললে কম বয়সে মেনোপজ আসার ঝুঁকি কমানো সম্ভব। তবে, কিছু ক্ষেত্রে জেনেটিক বা অন্য শারীরিক কারণের কারণে মেনোপজ ঠেকানো কঠিন হতে পারে।
কোন মন্তব্য নেই