Header Ads

মেটাস্ট্যাসিস কী? ক্যান্সার বৃদ্ধির প্রক্রিয়া ও লক্ষণ সমূহ

ক্যান্সার বর্তমান বিশ্বের একটি খুবই ভয়ংকর ভাবে ক্রমবর্ধমান রোগ। ক্যান্সারের কারণে প্রতিবছর বিশ্বে লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটে। ক্যান্সারের অনেক প্রকার ও শ্রেণী রয়েছে। এই সকল প্রকারভেদের মধ্যে মেটাস্ট্যাসিস অন্যতম। এটি একটি মারণঘাতি রোগ, যাতে প্রতিবছর সারা পৃথিবীতে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। আজকের আলোচনায় আমরা মেটাস্ট্যাসিস সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো।

মেটাস্ট্যাসিস কী?

মেটাস্ট্যাসিস (Metastasis) হলো ক্যান্সারের এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে ক্যান্সারের কোষগুলি তাদের মূল অবস্থান থেকে শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এটি সাধারণত রক্ত বা লসিকা (lymphatic system) সিস্টেমের মাধ্যমে ঘটে থাকে। মেটাস্ট্যাসিস হওয়ার কারণে ক্যান্সার আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, কারণ এটি শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেইসব অঙ্গের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা নষ্ট করে দেয়।


এটি সাধারণত বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, যেমন ফুসফুস, লিভার, হাড়, এবং মস্তিষ্ক। মেটাস্ট্যাটিক ক্যান্সার চিকিৎসা করা কঠিন হতে পারে এবং এর জন্য সাধারণত উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতির প্রয়োজন হয়। সাধারণত মেটাস্ট্যাসিস শনাক্ত করার জন্য চিকিৎসকেরা বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে রোগীর শরীরে ক্যান্সারের বিস্তার পরিমাপ করেন।

মেটাস্ট্যাসিস কোথায় হয়?

মেটাস্ট্যাসিস সাধারণত শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ও প্রত্যঙ্গে হতে পারে। এটি ক্যান্সারের ধরন এবং তার অবস্থানের উপর নির্ভর করে। কিছু সাধারণ স্থানের মধ্যে রয়েছে:

ফুসফুস: ক্যান্সার কোষগুলি ফুসফুসে পৌঁছে নতুন টিউমার তৈরি করতে পারে, যা শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।

লিভার: লিভারে মেটাস্ট্যাটিক টিউমার সৃষ্টি হলে এটি লিভারের কার্যক্ষমতা হ্রাস করতে পারে এবং জন্ডিসের মতো লক্ষণ সৃষ্টি করতে পারে।

হাড়: ক্যান্সারের কোষগুলি হাড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা হাড়ের দুর্বলতা এবং ব্যথার কারণ হতে পারে।

মস্তিষ্ক: মেটাস্ট্যাটিক ক্যান্সার মস্তিষ্কে পৌঁছালে মাথাব্যথা, মৃগী বা অন্যান্য নিউরোলজিক্যাল সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

ঘাড়ে মেটাস্ট্যাসিস

লিম্ফ নোড: ক্যান্সার কোষগুলি লিম্ফ নোডে ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা স্বল্পকালীন বা দীর্ঘমেয়াদী লিম্ফ্যাটিক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।

ত্বক: ক্যান্সার কোষগুলি ত্বকে মেটাস্ট্যাটিক lesions সৃষ্টি করতে পারে, যা নতুন ত্বক টিউমারের সৃষ্টি করতে পারে।

মেটাস্ট্যাসিসের স্থান ক্যান্সারের প্রাথমিক উৎসের উপর নির্ভর করে। যেমন, স্তনের ক্যান্সার সাধারণত ফুসফুস, লিভার, এবং হাড়ে মেটাস্ট্যাসিস করে, এবং মলদ্বারের ক্যান্সার সাধারণত লিভার এবং লিম্ফ নোডে মেটাস্ট্যাসিস করে।

মেটাস্ট্যাসিস কেন হয়?

মেটাস্ট্যাসিস ক্যান্সার ঘটে যখন ক্যান্সারের কোষগুলি তাদের মূল টিউমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রক্রিয়া ঘটে বিভিন্ন কারণে, যার মধ্যে কিছু মূল কারণ হলো:

ক্যান্সার কোষের বৈশিষ্ট্য: ক্যান্সার কোষগুলি স্বাভাবিক কোষের তুলনায় অধিক আক্রমণাত্মক ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পেয়ে এগুলি অন্য টিস্যুতে প্রবেশ করে নতুন টিউমার গঠন করতে সক্ষম হলে এই ক্যান্সারের সৃষ্টি হয়।

জিনগত পরিবর্তন: ক্যান্সারের কোষের জিনগত পরিবর্তন বা মিউটেশন ঘটলে তারা শরীরের স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া এড়িয়ে যায় এবং ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা অর্জন করে তখন ক্যান্সার হয়।

ভাস্কুলার সিস্টেম: যদি ক্যান্সার কোষগুলি রক্তনালীর মাধ্যমে অন্যান্য অঙ্গে পৌঁছে যায়। তারা রক্তনালীতে প্রবেশ করে এবং সেখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে নতুন স্থানে টিউমার গঠন করে তখন মেটাস্ট্যাসিসের জন্ম হয়।

লিম্ফ্যাটিক সিস্টেম: ক্যান্সার কোষগুলি লিম্ফ নোডে প্রবেশ করে লিম্ফ্যাটিক সিস্টেমের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্যান্সার ছড়ানোর আরেকটি পথ হতে পারে।

শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা: ক্যান্সারের কোষগুলি প্রায়ই শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়, যা তাদের ছড়িয়ে পড়ার প্রক্রিয়া সহজতর করে।

অঙ্গের পরিবেশ: ক্যান্সার কোষগুলি নতুন অঙ্গের পরিবেশে বসবাস করতে এবং বৃদ্ধি পেতে সক্ষম হয়। কিছু অঙ্গের পরিবেশ ক্যান্সার কোষের জন্য উপযুক্ত এবং তারা সেখানে দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

মেটাস্ট্যাটিক ক্যান্সার হওয়ার প্রক্রিয়া একটি জটিল বিষয় এবং এটি বিভিন্ন ফ্যাক্টরের সমন্বয়ে ঘটে। গবেষকরা এই প্রক্রিয়াগুলি বোঝার চেষ্টা করে চলেছেন যাতে ক্যান্সার প্রতিরোধ এবং চিকিৎসার জন্য নতুন উপায় বের করা যায়।

মেটাস্ট্যাসিসের বৃদ্ধি প্রক্রিয়া:

মেটাস্ট্যাসিসের বৃদ্ধি প্রক্রিয়া বিভিন্ন পর্যায়ে ঘটে। এই পর্যায়গুলোকে নিম্নলিখিতভাবে ব্যাখ্যা করা যায়:

ক্যান্সারের কোষগুলি প্রথমে তাদের মূল টিউমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই ধাপে কোষগুলি তাদের সংযোগকারী টিস্যুর (স্ট্রমা) সাথে নিজেদের বন্ধন ভেঙে দেয়।

বিচ্ছিন্ন হওয়া ক্যান্সার কোষগুলি আক্রমণাত্মকভাবে আশেপাশের টিস্যুর মধ্যে প্রবেশ করে এবং নতুন স্থানে যেতে শুরু করে। এটি সাধারণত কোষের চলন ক্ষমতা (motility) বৃদ্ধির মাধ্যমে ঘটে।

ক্যান্সার কোষগুলি রক্তনালী (blood vessels) বা লিম্ফ্যাটিক সিস্টেমে প্রবেশ করে। এটি বিভিন্ন অঙ্গে পৌঁছানোর জন্য একটি প্রধান মাধ্যম।

রক্ত বা লিম্ফে প্রবেশ করার পর, ক্যান্সার কোষগুলি অন্যান্য অঙ্গে পৌঁছে বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। যেমন, তারা নতুন পরিবেশে টিকে থাকার জন্য বিভিন্ন প্রোটিন বা সিগন্যালিং মোডুলেটর উৎপন্ন করতে পারে।

ক্যান্সার কোষগুলি নতুন অঙ্গে পৌঁছানোর পর, তারা দ্রুত বিভাজন শুরু করে এবং সেখানে নতুন টিউমার তৈরি করতে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় ক্যান্সার কোষগুলি সেই অঙ্গের টিস্যুর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে এবং নতুন টিউমার সৃষ্টি করে।

মেটাস্ট্যাটিক ক্যান্সার কোষগুলি শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে এড়াতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে, যেমন ইমিউন সেলগুলির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা।

নতুন টিউমার গঠনের জন্য রক্তনালীর (blood vessels) বৃদ্ধি প্রয়োজন। ক্যান্সার কোষগুলি নতুন রক্তনালী গঠনের জন্য সিগন্যালিং মলিকিউল তৈরি করে, যা টিউমারকে পুষ্টি এবং অক্সিজেন সরবরাহ করে।

ফুসফুসে মেটাস্ট্যাসিস 

মেটাস্ট্যাসিসের এই বৃদ্ধি প্রক্রিয়া জটিল এবং বিভিন্ন জিন, প্রোটিন এবং সিগন্যালিং পথের সমন্বয়ে ঘটে। গবেষকরা এই প্রক্রিয়াগুলি বোঝার মাধ্যমে ক্যান্সারের প্রতিরোধ ও চিকিৎসার নতুন পদ্ধতি বের করার চেষ্টা করে চলেছেন। 

মেটাস্ট্যাসিসের লক্ষণ সমুহ:

মেটাস্ট্যাসিসের লক্ষণগুলি ক্যান্সারের প্রাথমিক অবস্থান এবং শরীরের যেসব অংশে মেটাস্ট্যাটিক কোষগুলি পৌঁছেছে, তার উপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে। তবে, কিছু সাধারণ লক্ষণ নিম্নলিখিত:

সাধারণ লক্ষণ:

  • অস্বাভাবিক ওজন কমা: কোনো স্পষ্ট কারণ ছাড়া দ্রুত ওজন কমে যাওয়া।
  • ক্লান্তি: অতিরিক্ত ক্লান্তি বা দুর্বলতা অনুভব করা।
  • ভোজনের অভাব: খেতে ইচ্ছা না করা বা খাদ্যের প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়া।

ফুসফুসে মেটাস্ট্যাসিস:

  • শ্বাসকষ্ট: শ্বাস নিতে অসুবিধা হওয়া।
  • হাঁপানি: হাঁপানি বা শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা।
  • কফে রক্ত: কফে রক্ত দেখা।

লিভারে মেটাস্ট্যাসিস:

  • পেটের ব্যথা: পেটে যন্ত্রণা বা অস্বস্তি।
  • জন্ডিস: ত্বক এবং চোখের সাদা অংশে হলদেটে ভাব আসা।
  • পেটের আকার পরিবর্তন: পেট ফুলে যাওয়া।

হাড়ে মেটাস্ট্যাসিস:

  • হাড়ের ব্যথা: বিশেষ করে পিঠে, কোমর, বা অন্যান্য অঙ্গে।
  • ভঙ্গুরতা: হাড় ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি।

মস্তিষ্কে মেটাস্ট্যাসিস:

  • মাথাব্যথা: ক্রমাগত মাথাব্যথা।
  • মৃগী বা নিউরোলজিক্যাল লক্ষণ: মৃগী, দৃষ্টিশক্তি বা শুনার সমস্যা।
  • ব্যক্তিত্ব পরিবর্তন: আচরণ বা মেজাজের পরিবর্তন।

লিম্ফ নোডে মেটাস্ট্যাসিস:

  • লিম্ফ নোডের ফুলে যাওয়া: ঘাড়, বক্ষ, বা গর্ভাশয়ে লিম্ফ নোডে ফুলে যাওয়া।
  • ত্বকে মেটাস্ট্যাসিস: ত্বকে নতুন lesions: ত্বকে নতুন দাগ বা ফুসকুড়ি দেখা।

মেটাস্ট্যাসিসের লক্ষণগুলি বিভিন্ন অঙ্গে ভিন্ন হতে পারে এবং এগুলি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যার মতো মনে হতে পারে। সুতরাং, যদি আপনি এই লক্ষণগুলির মধ্যে কোনওটি অনুভব করেন, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। রোগের অবস্থার সঠিক মূল্যায়নের জন্য চিকিৎসকের পরীক্ষা এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করা জরুরি।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.