চোখ উঠা কী? কারণ, চোখ উঠার লক্ষণ এবং প্রাথমিক চিকিৎসা
চোখ উঠা
আমাদের অতিপরিচিত একটি চোখের অসূখ। এটি সব বয়সী মানুষদের এবং নারী-পুরুষের সবার
ক্ষেত্রে হতে পারে। চোখ উঠা একটি সংক্রামক রোগ। একজন আক্রান্ত হলে তার থেকে অন্য
যে কেউ এই অসূখে সংক্রামিত হতে পারে। এটি কোনও মারাত্নক সমস্যা নয়। চোখ উঠার কিছু
দিন পর এটি নিজে নিজে সেরে যায়। আজকের আলোচনায় আমরা চোখ উঠা নিয়ে বিস্তারিত ভাবে
জানার চেষ্টা করবো।
চোখ উঠা আসলে
কী?
চোখ উঠা বা Pink Eye যা চিকিৎসাবিজ্ঞানে কনজাঙ্কটিভাইটিস (Conjunctivitis) নামে পরিচিত। এটি হলো চোখের কনজাঙ্কটিভা নামক পাতলা স্তরের প্রদাহ। কনজাঙ্কটিভা হলো চোখের সাদা অংশের উপর ও চোখের পাতা ঢেকে রাখা একটি পাতলা আবরণ, যা সংক্রমণ বা প্রদাহের কারণে লালচে হয়ে যায়। চোখ উঠার কারণে চোখ লালচে, ফুলে যাওয়া, সাদা পদার্থ জমা হওয়া এবং চুলকানি বা জ্বালা অনুভূত হয়। এটি সাধারণত ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, অ্যালার্জি বা অন্যান্য কারণের জন্য হতে পারে।
চোখ উঠার কারণ:
চোখ উঠা বা
কনজাঙ্কটিভাইটিস অনেক গুলো কারণে হতে
পারে। প্রধান কারণগুলো নিম্নে বর্ণনা করা হলো:
ভাইরাসজনিত সংক্রমণ:
• সাধারণত
অ্যাডেনোভাইরাস দ্বারা সংক্রমণ হয়,
যা ঠান্ডা
লাগার মতো সাধারণ ঠান্ডা, ফ্লু বা শ্বাসযন্ত্রের
সংক্রমণের সঙ্গে যুক্ত।
• এই ভাইরাসজনিত চোখ উঠা
অত্যন্ত সংক্রামক এবং এটি দ্রুত একজন থেকে অন্য জনে ছড়াতে পারে।
ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ:
• স্ট্যাফিলোকক্কাস (Staphylococcus), স্ট্রেপটোকক্কাস (Streptococcus), অথবা হেমোফিলাস (Haemophilus) ব্যাকটেরিয়ার কারণে এই সংক্রমণ হতে পারে।
• এটি সহজেই একজন থেকে
অন্য জনের কাছে ছড়াতে পারে এবং সাধারণত এর চিকিৎসার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক আই
ড্রপ বা মলমের প্রয়োজন হয়।
অ্যালার্জিজনিত প্রতিক্রিয়া:
• পরাগ, ধুলা, পশম, বা অন্য কোনো অ্যালার্জি উদ্দীপকের কারণে অ্যালার্জিজনিত
চোখ উঠা হতে পারে।
• অ্যালার্জির কারণে চোখ
লাল হওয়া, চুলকানো ও পানি পড়া
সাধারণ লক্ষণ।
জ্বালাময় রাসায়নিক বা পদার্থ:
• ধোঁয়া, ধুলা, সাবান, ক্লোরিনযুক্ত পানি (যেমন সুইমিং পুলের পানি) বা অন্য
কোনো রাসায়নিক পদার্থ চোখে লাগলে চোখ উঠার সমস্যা হতে পারে।
বাইরের বস্তু বা চোখের আঘাত:
• ধূলিকণা, ছোট কণা, বা ময়লা চোখে পড়লে
প্রদাহ বা চোখ উঠা হতে পারে। চোখে আঘাত লাগার কারণেও এই সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।
কনট্যাক্ট লেন্সের ব্যবহার:
• অপরিষ্কার কনট্যাক্ট
লেন্স পরিধান করলে বা সেগুলি ঠিকমতো সংরক্ষণ না করলে চোখে সংক্রমণ হতে পারে।
অটোইমিউন বা অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা:
• কিছু অটোইমিউন ডিজিজ
বা চোখের অন্যান্য প্রদাহজনিত সমস্যা থেকেও চোখ উঠা সমস্যার সূত্রপাত হতে পারে।
চোখ উঠা
সংক্রামক হলে এটি খুব সহজেই অন্যদের মাঝে ছড়াতে পারে, তাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা এবং ব্যক্তিগত জিনিস যেমন
তোয়ালে, বালিশের কাভার অন্যের সাথে ভাগ না করা
গুরুত্বপূর্ণ।
চোখ উঠার লক্ষণ সমূহ:
চোখ উঠা বা
কনজাঙ্কটিভাইটিসের অবস্থা ভেদে বিভিন্ন ধরনের লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায়। চোখ উঠার সাধারণ লক্ষণগুলো নিম্নে চিত্রিত করা হলো:
চোখ লাল হয়ে
যাওয়া: সংক্রমণ বা প্রদাহের কারণে চোখের সাদা অংশ লাল হয়ে যায়।
চুলকানি বা
জ্বালা: চোখে চুলকানো ও জ্বালার অনুভূতি হয়।
চোখে পানি
পড়া: চোখ থেকে অস্বাভাবিক পরিমাণে পানি পড়তে থাকে।
চোখে আঠালো
পদার্থ জমা হওয়া: ব্যাকটেরিয়াজনিত চোখ উঠা হলে সাধারণত পুঁজের মতো আঠালো পদার্থ
জমে, যা ঘুমের পর চোখের পাতা আটকে দিতে পারে।
আলোতে
সংবেদনশীলতা: আলোতে চোখে অস্বস্তি বা ব্যথা অনুভব হতে পারে।
চোখ ভারী বা
ফুলে যাওয়া: চোখের চারপাশে ফোলা ভাব দেখা দিতে পারে।
দৃষ্টির
সমস্যা: কখনও কখনও দৃষ্টির সাময়িক ঝাপসা দেখা দিতে পারে, বিশেষ করে সংক্রমণ গুরুতর হলে।
চোখ উঠার এই
লক্ষণগুলো দেখা দিলে তাড়াতাড়ি চিকিৎসা নেওয়া উচিত, কারণ সংক্রমণ
দ্রুত ছড়াতে পারে এবং সময়মতো চিকিৎসা না করলে দৃষ্টিশক্তির ক্ষতি হতে পারে।
চোখ উঠার চিকিৎসা:
চোখ উঠা বা
কনজাঙ্কটিভাইটিসের চিকিৎসা নির্ভর করে সংক্রমণের কারণের উপর। এখানে কিছু সাধারণ
চিকিৎসা পদ্ধতি আলোচনা করা হলো:
ভাইরাসজনিত চোখ উঠা:
• সাধারণত নিজে থেকেই
৭-১০ দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায়।
• সংক্রমণের উপসর্গ
কমানোর জন্য ঠান্ডা পানির সেঁক দেওয়া যেতে পারে।
• পরিষ্কার কাপড় বা
তুলা ব্যবহার করে চোখে থাকা ময়লা পরিষ্কার করুন।
• অন্যান্য লোকের থেকে
দূরে থাকুন, কারণ এটি খুবই
সংক্রামক।
ব্যাকটেরিয়াজনিত চোখ উঠা:
• চিকিৎসকের পরামর্শ
অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক আই ড্রপ বা মলম ব্যবহার করতে হবে।
• সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া
রোধ করতে হাত পরিষ্কার রাখুন এবং অন্যের সাথে তোয়ালে বা বালিশ ভাগ করবেন না।
• চিকিৎসকের নির্দেশিত
সময় পর্যন্ত পুরো অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করুন, যেন সংক্রমণ
সম্পূর্ণরূপে নিরাময় হয়।
অ্যালার্জিজনিত চোখ উঠা:
• অ্যালার্জিজনিত কারণে
চোখ উঠলে অ্যান্টিহিস্টামিন বা অ্যালার্জি প্রতিরোধক আই ড্রপ ব্যবহার করা যেতে
পারে।
• অ্যালার্জির উৎস থেকে
দূরে থাকুন, যেমন ধুলা, ধোঁয়া বা পরাগ।
• প্রয়োজনে চিকিৎসকের
সাথে পরামর্শ করে অ্যালার্জি নিয়ন্ত্রণের ওষুধ ব্যবহার করতে পারেন।
জ্বালাময় পদার্থ বা রাসায়নিকের কারণে চোখ উঠা:
• যদি কোনো রাসায়নিক
পদার্থ চোখে পড়ে, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে
প্রচুর পরিমাণে পরিষ্কার পানি দিয়ে চোখ ধুয়ে ফেলুন।
• এরপর চিকিৎসকের
পরামর্শ নিন।
সাধারণ পরামর্শ:
• সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার
আশঙ্কা কমাতে চোখে বারবার হাত দিবেন না।
• নিজস্ব তোয়ালে, বালিশের কাভার, এবং প্রসাধনী
ব্যবহার করুন এবং অন্যদের সাথে এসব ভাগ করবেন না।
• বিশ্রাম নিন এবং আলো
থেকে দূরে থাকুন, কারণ অতিরিক্ত আলোতে
চোখে অস্বস্তি হতে পারে।
• প্রতিদিন পরিষ্কার
পানি দিয়ে চোখ পরিষ্কার করুন এবং যেকোনো জমে থাকা ময়লা বা আঠালো পদার্থ তুলা
দিয়ে মুছে ফেলুন।
চোখ উঠা যদি
দীর্ঘস্থায়ী হয় বা উপসর্গ গুরুতর হয়, তবে দ্রুত
চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
চোখ উঠলে কখন ডাক্তার দেখানো উচিত:
চোখ উঠলে
সাধারণত কিছুদিনের মধ্যে নিজে থেকেই সেরে যায়। তবে নিচের কিছু লক্ষণ থাকলে দ্রুত
চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত:
- চোখে প্রচণ্ড ব্যথা বা অস্বাভাবিক ফুলে গেলে।
- দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হওয়া বা দৃষ্টিশক্তি কমে গেলে।
- তীব্র আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা তৈরি হলে।
- ৭-১০ দিনের বেশি চোখ উঠা স্থায়ী হলে।
- চোখ থেকে বেশি পরিমাণে পুঁজ বা আঠালো পদার্থ নির্গত হলে।
- অতিরিক্ত জ্বালা বা চুলকানি অনুভূত হলে।
- শিশু বা নবজাতকের ক্ষেত্রে চোখ উঠলেই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
এই লক্ষণগুলো
দেখা দিলে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত, কারণ চোখের সংক্রমণ সময়মতো চিকিৎসা না করলে
দৃষ্টিশক্তির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
কোন মন্তব্য নেই