রোটা ভাইরাস কী? শিশুদের লক্ষণ, কারণ এবং টিকার চিকিৎসা
শিশুরা বিভিন্ন কারণে বমি ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এই বমি ও ডায়রিয়ার কারণ হিসেবে আমরা বিভিন্ন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াকে দায়ী করতে পারি। রোটা ভাইরাস বিশেষ এক ধরনের ভাইরাস। এটি শিশুদের সংক্রমিত করে এবং শিশুদের এর কারণে মৃত্যুও হতে পারে। বিশেষ ভ্যাকসিনের মাধ্যমে এই রোগ প্রতিরোধ বা চিকিৎসা করা হয়। আজকের আলোচনায় আমরা শিশুদের রোটা ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
রোটা ভাইরাস
কী?
রোটা ভাইরাস (Rotavirus) হলো একটি highly contagious বা অত্যন্ত সংক্রামক ভাইরাস, যা প্রধানত শিশুদের মধ্যে ডায়রিয়া, বমি এবং পেটে ব্যথার কারণ হয়ে থাকে। এটি প্রায়শই ৫ বছর পর্যন্ত শিশুদের মধ্যে দেখা যায় এবং বিশ্বজুড়ে শিশু মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ।
রোটা ভাইরাস
একটি RNA ভাইরাস, যা শিশুদের
মধ্যে গুরুতর ডায়রিয়া এবং পেটের অসুখের অন্যতম প্রধান কারণ। এটি রেওভারিডি (Reoviridae) পরিবারভুক্ত ভাইরাস এবং মূলত শিশুরা যখন কোনো
ভাবে এই ভাইরাসটির সংস্পর্শে আসে তখন এটি শরীরে সংক্রমণ ঘটায়। সাধারণত এটি
মল-মূত্রের মাধ্যমে ছড়ায় এবং খুব সহজেই একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে
পারে।
রোটা ভাইরাস কাদের হয়:
যে কোনও ব্যক্তিই রোটা
ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে, তবে এটি সাধারণত যাদের
সংক্রমিত করে তারা হলো:
- শিশুরা
- ছোট বাচ্চারা
- আক্রান্ত ব্যক্তির নিকটাত্মীয়
- যারা শিশুদের নিয়ে কাজ করেন, যেমন আয়া বা শিশু পরিচর্যা কর্মী
রোটা ভাইরাসের কারণ:
রোটা ভাইরাস
সংক্রমণের কারণ হলো রোটা ভাইরাস নিজেই,
যা অত্যন্ত
সংক্রামক এবং সহজেই এক জন থেকে অন্য জনে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এটি একটি RNA ভাইরাস। এই ভাইরাসটি প্রধানত ক্ষুদ্রান্ত্রের (small intestine) কোষগুলিতে সংক্রমণ ঘটায় এবং সেখানেই
সংক্রমিত কোষগুলিকে নষ্ট করে দেয়, ফলে ডায়রিয়া, বমি ও অন্যান্য উপসর্গ দেখা দেয়।
রোটা ভাইরাস ছড়ানোর মাধ্যম:
রোটা ভাইরাস
একটি সংক্রামক রোগ। এটি খুব সহজে এক জন থেকে অন্য জনে ছড়িয়ে পড়তে পারে। রোটা
ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার প্রধান উৎস গুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো।
মল-মূত্রের মাধ্যমে:
রোটা ভাইরাস
সংক্রামিত ব্যক্তির মলের মাধ্যমে পরিবেশে ছড়ায় এবং এটি পানি, খাদ্য, শিশুদের খেলনা, এবং অন্যান্য জিনিসের সাথে অবস্থান করতে পারে। সংক্রমিত
কোনো ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা বা সেই ব্যক্তি যেসব জিনিস স্পর্শ করেছে, সেগুলো অন্য কেউ স্পর্শ করলেই এই ভাইরাস অন্যের শরীরে
প্রবেশ করতে পারে।
দূষিত পানি ও খাদ্য:
যদি পানি বা
খাদ্য রোটা ভাইরাস দ্বারা দূষিত হয়,
তা গ্রহণের
মাধ্যমে সংক্রমণ ঘটে। অনেক সময় হাত না ধুয়ে খাবার খাওয়াও এই ভাইরাস শরীরে প্রবেশ
করাতে পারে।
পরিচ্ছন্নতার অভাব:
শিশুদের মধ্যে
রোটা ভাইরাস সংক্রমণের অন্যতম কারণ হলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব। শিশুরা প্রায়ই
মাটিতে খেলে এবং মুখে হাত দেয়, ফলে ভাইরাসটি সহজে
শিশুর শরীরে প্রবেশ করতে পারে।
খেলনা ও অন্যান্য জিনিস:
সংক্রামিত
শিশু বা ব্যক্তির স্পর্শকৃত খেলনা, জামা-কাপড়, বা অন্যান্য জিনিসে ভাইরাসটি লেগে থাকে। স্পর্শকৃত এই
জিনিস গুলো অন্য কেও বা অন্য কোনও শিশুর স্পর্শে গেলে সেও রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত
হয়ে পড়ে।
শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অভাব:
শিশুদের শরীরে
প্রাথমিক সময়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে গড়ে না ওঠার কারণে রোটা ভাইরাস
খুব সহজে অন্যের নিকট থেকে শিশুর শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
রোটা ভাইরাসের লক্ষণ:
রোটা ভাইরাস
সংক্রমণের ফলে প্রধানত শিশুদের মধ্যে পেটের সমস্যা দেখা দেয়। এর কিছু সাধারণ লক্ষণ
হলো:
মারাত্মক
ডায়রিয়া: রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে পানির মতো পাতলা ডায়রিয়া হয়, যা দিনে কয়েকবার হতে পারে এবং দীর্ঘসময় স্থায়ী হতে পারে।
বমি: সাধারণত
ডায়রিয়ার সঙ্গে বমি হয়, যা শরীর থেকে আরও
দ্রুত পানি বের করে দেয় এবং ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতার ঝুঁকি বাড়ায়।
পেটে ব্যথা:
অনেক সময় শিশুর পেটে ব্যথা হয়, এবং শিশুর মধ্যে
মারাত্নক অস্বস্তি দেখা দেয়।
জ্বর: রোটা
ভাইরাস সংক্রমণের ফলে সাধারণত হালকা থেকে মাঝারি মাত্রার জ্বর হতে পারে। শিশুদের
এই জ্বর ১০০ ডিগ্রী ফারেনহাইট থেকে ১০২ ডিগ্রী ফারেনহাইট হতে পারে।
ক্ষুধামান্দ্য
এবং দুর্বলতা: রোটা ভাইরাসের সংক্রমণের সময় শিশুরা সাধারণত খাওয়ার রুচি হারিয়ে
ফেলে এবং তাদের শরীর ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে পড়ে।
ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা: অতিরিক্ত ডায়রিয়া ও বমির কারণে শিশুর শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে পানি ও লবণ বের হয়ে যায়, যা পানিশূন্যতার সৃষ্টি করে। শিশুদের পানিশূন্যতার লক্ষণ সমূহ নিম্নরুপ:
- মুখ ও ত্বক শুকিয়ে যাওয়া
- ঘন ঘন প্রস্রাব না হওয়া
- ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া
- চোখের নিচে গর্ত তৈরি হওয়া
- আচরণে অবসাদ এবং খিটখিটে ভাব
রোটা ভাইরাস
সংক্রমণে ডিহাইড্রেশন খুবই বিপজ্জনক হতে পারে, বিশেষত
শিশুদের জন্য। ডিহাইড্রেশনের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসা নেয়া জরুরি।
রোটা ভাইরাসের চিকিৎসা:
রোটা ভাইরাসের
নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ বা চিকিৎসা নেই,
তবে লক্ষণ
উপশম এবং পানিশূন্যতা প্রতিরোধই এই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সেরে ওঠার মূল পদ্ধতি।
সংক্রমণ হলে শিশুদের শরীরে যথেষ্ট তরল এবং প্রয়োজনীয় ইলেকট্রোলাইট সরবরাহ নিশ্চিত
করাই এর মূল চিকিৎসা।
ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন:
ডায়রিয়া ও
বমির মাধ্যমে শরীর থেকে পানি ও লবণ বের হয়ে যায়, যা শরীরে
পানিশূন্যতা তৈরি করে। স্যালাইন পান করানোর মাধ্যমে এই ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। এটি
সহজে শরীরের তরলের ঘাটতি পূরণ করতে সাহায্য করে এবং পানিশূন্যতা প্রতিরোধ করে।
পানির সরবরাহ:
পর্যাপ্ত
পরিমাণে পানি পান করানো উচিত। পানির সাথে ফলের রস, ডাবের পানি, এবং স্যুপের মতো তরল জাতীয় খাবারও দেয়া যেতে পারে। বাজার
থেকে ভাল কোম্পানীর ইলেকট্রোলাইট ড্রিংকও শিশুদের খেতে দিতে পারেন।
হালকা খাবার:
রোটা ভাইরাসে
আক্রান্ত হলে শিশুকে সহজে হজম হয় এমন খাবার দেয়া ভালো, যেমন: নরম ভাত, কলা, স্যুপ, টোস্ট ইত্যাদি।
জ্বর ও ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল:
যদি শিশুর
জ্বর বা পেটের ব্যথা থাকে, তবে প্যারাসিটামল
ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ দেয়া উচিত নয়।
প্রোবায়োটিক:
প্রোবায়োটিক
সাপ্লিমেন্টস বা খাবার যেমন দই, আপেল সিডার ভিনেগার
ইত্যাদি কিছু ক্ষেত্রে শিশুকে খাওয়াতে পারেন। এই গুলো অন্ত্রের ভালো ব্যাকটেরিয়াকে
বৃদ্ধি করে এবং ডায়রিয়ার সময় উপকারী হতে পারে।
শিশুকে বারবার পর্যবেক্ষণ:
পানি শূন্যতার
জন্য শিশুদের শরীরের লক্ষণগুলো পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। মুখ শুকানো, ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া, বারবার
প্রস্রাব না হওয়া, খিটখিটে মেজাজ, ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিলে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসা প্রয়োজন।
রোটা ভাইরাস প্রতিরোধ করার উপায়:
রোটা ভাইরাসের
সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে কিছু কার্যকরী উপায় আছে, বিশেষ করে
শিশুদের সুরক্ষার জন্য। নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলো এই ভাইরাস প্রতিরোধে সহায়ক হতে
পারে:
রোটা ভাইরাসের টিকা:
রোটা ভাইরাস
প্রতিরোধে ভ্যাকসিন সবচেয়ে কার্যকর উপায়। শিশুদের জন্য রোটা ভাইরাসের নির্ধারিত
টিকা রয়েছে, যা সাধারণত শিশুর ৬
থেকে ১৫ সপ্তাহ বয়সে দেয়া হয়। এটি ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি কমায় এবং লক্ষণগুলোকে
মৃদু করে।
হাত ধোয়া:
খাবার আগে এবং
বাথরুম ব্যবহার করার পর ভালোভাবে হাত ধোয়ার অভ্যাস সংক্রমণ প্রতিরোধে
গুরুত্বপূর্ণ। শিশুরা প্রায়ই মুখে হাত দেয়, তাই তাদের হাত
পরিষ্কার রাখা অত্যন্ত জরুরি।
পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা:
শিশুদের খেলনা, খাওয়ার জিনিসপত্র এবং অন্যান্য জিনিসগুলো নিয়মিত
পরিষ্কার রাখা উচিত। ভাইরাসটি সহজেই বিভিন্ন পৃষ্ঠে অবস্থান করতে পারে, তাই নিয়মিত জীবাণুমুক্ত করাও প্রয়োজন।
সচেতনতা বজায় রাখা:
ভাইরাস
সংক্রমিত শিশু বা ব্যক্তির কাছাকাছি আসা থেকে বিরত থাকা উচিত, কারণ রোটা ভাইরাস অত্যন্ত সংক্রামক। বাচ্চাদের ভাইরাস
আক্রান্ত ব্যক্তিদের সাথে মেলামেশা এড়িয়ে চলাই ভালো।
খাবারের পরিচ্ছন্নতা:
শিশুদের খাবার
ও পানি নিরাপদ ও পরিষ্কার থাকতে হবে। পানি ফুটিয়ে বা বিশুদ্ধ করে দেওয়া উচিত এবং
খাবার তৈরি ও পরিবেশনে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে।
বাড়িতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার নিয়ম পালন:
বাড়ির টয়লেট
এবং রান্নাঘর নিয়মিত জীবাণুমুক্ত করতে হবে। শিশুরা প্রায়শই টয়লেট বা রান্নাঘরের
বিভিন্ন জিনিস স্পর্শ করে, তাই এই জায়গাগুলোর
পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
রোটা ভাইরাসের টিকা:
রোটা ভাইরাসের
টিকা শিশুদের রোটা ভাইরাস সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এটি শিশুদের মারাত্মক ডায়রিয়া ও অন্যান্য উপসর্গের ঝুঁকি কমায় এবং হাসপাতালে
ভর্তির প্রয়োজনও অনেকাংশে কমিয়ে দেয়।
রোটা ভাইরাস টিকার বিবরণ:
টিকার ধরন:
রোটা ভাইরাসের
টিকা সাধারণত মুখে প্রয়োগ করা হয় এবং এটি তরল আকারে দেওয়া হয়। প্রধানত দুটি
ধরনের রোটা ভাইরাস টিকা বাজারে পাওয়া যায়:
- রোটাটেক (RotaTeq)
- রোটারিক্স (Rotarix)
টিকা প্রদানের
সময়সূচি:
রোটা ভাইরাস
টিকার সময়সূচি দেশের স্বাস্থ্য নীতির উপর নির্ভর করে কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। তবে
সাধারণত শিশুর জন্মের পর নিম্নলিখিত সময়ে টিকা দেওয়া হয়:
- প্রথম ডোজ: ৬ সপ্তাহ থেকে ১৫ সপ্তাহ বয়সের মধ্যে
- দ্বিতীয় ডোজ: ১০ থেকে ২৪ সপ্তাহের মধ্যে
- তৃতীয় ডোজ (যদি প্রয়োজন হয়): নির্দিষ্ট বয়সের মধ্যে
রোটারিক্স
সাধারণত দুই ডোজে সম্পন্ন হয়, এবং রোটাটেক তিনটি
ডোজে সম্পন্ন হয়।
কার্যকারিতা:
রোটা ভাইরাসের
টিকা ৮৫-৯৫% ক্ষেত্রে কার্যকরী এবং এটি শিশুরা রোটা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে গুরুতর
অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি কমিয়ে দেয়। টিকা নেয়ার পরও শিশুরা সামান্য সংক্রমিত হতে
পারে, তবে লক্ষণগুলো সাধারণত মৃদু হয়।
টিকার
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:
সাধারণত রোটা ভাইরাস টিকা নিরাপদ, তবে কিছু ক্ষেত্রে শিশুদের সামান্য জ্বর, অস্বস্তি, বা ডায়রিয়ার মতো মৃদু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। এগুলো সাধারণত ক্ষণস্থায়ী হয় এবং দ্রুত সেরে যায়।
যদি শিশুর কোনো ধরনের অন্ত্রের সমস্যা বা ইমিউন সিস্টেম দুর্বল থাকে, তবে টিকা দেওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। টিকা নির্দিষ্ট সময়ে দেয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি নির্ধারিত বয়সের পরে কার্যকরী নাও হতে পারে। রোটা ভাইরাসের টিকা একটি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা, যা শিশুদের মারাত্মক ডায়রিয়া ও ডিহাইড্রেশনের ঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে কার্যকর।
কোন মন্তব্য নেই