টাইপ ১ ডায়াবেটিস কী? এটা হওয়ার কারণ, লক্ষণ এবং জটিলতা
টাইপ ১ ডায়াবেটিস হলো একটি অটোইমিউন রোগ, যেখানে শরীরের রোগপ্রতিরোধী ব্যবস্থা প্যানক্রিয়াসের ইনসুলিন উৎপাদনকারী বিটা কোষগুলিকে আক্রমণ করে এবং ধ্বংস করে ফেলে। বর্তমানে এই রোগটি বিশ্বব্যাপী খুবই পরিচিত। বিশেষ করে উন্নত দেশ এবং উন্নয়নশীল দেশে এই রোগটি খুবই বেশি দেখা যায়। আজকের আলোচনায় আমরা বিস্তারিত ভাবে জানার চেষ্টা করবো টাইপ ১ ডায়াবেটিস সম্পর্কে।
টাইপ ১ ডায়াবেটিস কী:
টাইপ ১ ডায়াবেটিস (Type 1 Diabetes) হলো একটি দীর্ঘমেয়াদী ক্রনিক অটোইমিউন রোগ, যেখানে শরীরের প্রতিরোধক ব্যবস্থা ভুলবশত অগ্ন্যাশয়ের (pancreas) ইনসুলিন উৎপাদনকারী বিটা কোষগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। এর ফলে, শরীর যথেষ্ট পরিমাণে ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না। ইনসুলিন হলো এমন একটি হরমোন, যা রক্তে শর্করা বা গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
টাইপ ১ ডায়াবেটিসের ফলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ না করলে বিভিন্ন জটিলতা, যেমন কিডনি সমস্যা, হৃদরোগ, স্নায়ুর সমস্যা, চোখের সমস্যা ইত্যাদির সৃষ্টি করতে পারে। টাইপ ১ ডায়াবেটিস সাধারণত শিশুকাল বা কৈশোরের শুরুতে হয়, তাই এটাকে আগে জুভেনাইল ডায়াবেটিস "Juvenile diabetes" ও বলা হতো।
টাইপ ১ ডায়াবেটিস হওয়ার কারণ:
টাইপ ১ ডায়াবেটিস
হওয়ার সঠিক কারণ এখনও পুরোপুরি জানা যায়নি। তবে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে এটি
মূলত অটোইমিউন প্রতিক্রিয়ার কারণে ঘটে, যেখানে শরীরের
নিজস্ব রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা ভুলবশত প্যানক্রিয়াসের ইনসুলিন উৎপাদনকারী বিটা
কোষগুলোকে আক্রমণ করে এবং ধ্বংস করে দেয়। ফলে ইনসুলিন তৈরি বন্ধ হয়ে যায়, যার কারণে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায়। টাইপ ১
ডায়াবেটিসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ নিম্নে বর্ণনা করা হলো:
জেনেটিক ফ্যাক্টর:
জেনেটিক্স বা
বংশগত ইতিহাসের কারণে টাইপ ১ ডায়াবেটিস হওয়ার আশংকা থাকতে পারে। কোনো পরিবারের
এক বা একাধিক সদস্য টাইপ ১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে এই
রোগ হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে। মা,
বাবা বা
রক্তের সম্পর্কের কারো টাইপ ১ ডায়াবেটিস থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের এই টাইপ
ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
অটোইমিউন প্রতিক্রিয়া:
শরীরের রোগ
প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভুল করে বিটা কোষগুলোকে "বাইরের শত্রু" হিসেবে
চিহ্নিত করে ধ্বংস করে দিলে শরীরে ইনসুলিন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়, তখন টাইপ ১ ডায়াবেটিসের আশংকা বেড়ে যায়।
পরিবেশগত কারণ:
বিশেষ কিছু
ভাইরাসের সংক্রমণ যেমন কক্সসাকি ভাইরাস শরীরে টাইপ ১ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়াতে
পারে। এছাড়া পরিবেশগত ফ্যাক্টরগুলো,
যেমন
বায়ুদূষণ, জীবাণু সংস্পর্শ, এবং দূষিত পরিবেশের কারণে এই রোগের সূত্রপাত হতে পারে।
প্রতিরোধী কোষগুলির ত্রুটি:
কিছু গবেষণায়
দেখা গেছে, যাদের টাইপ ১
ডায়াবেটিস হয় তাদের শরীরের কিছু বিশেষ ধরণের কোষ যেমন T-cells সঠিকভাবে কাজ করতে
ব্যর্থ হয়, যা বিটা কোষগুলোকে
ধ্বংস করতে উৎসাহিত করে, এবং ডায়াবেটিসের আশংকা
বেড়ে যায়।
বয়সের জন্য:
টাইপ ১
ডায়াবেটিস যে কোনো বয়সে হতে পারে,
তবে এটি দুটি
লক্ষণীয় স্তরে ঝুঁকি বাড়াতে পারে। প্রথম স্তর ৪ থেকে ৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে
ঘটে। দ্বিতীয়টি ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে ঘটে।
সতর্কতা: আমরা
অনেকেই জানি জীবনধারা বা খাদ্যাভ্যাসের কারণে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়, কিন্তু টাইপ ১ ডায়াবেটিস সাধারণত জীবনধারার কারণ বা
খাদ্যাভ্যাসের কারণে হয় না।
টাইপ ১ ডায়াবেটিসের লক্ষণ:
টাইপ ১
ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলো সাধারণত হঠাৎ করেই দেখা দেয় এবং দ্রুত গুরুতর হয়ে উঠতে
পারে। এর প্রধান লক্ষণগুলো হলো:
অতিরিক্ত
তৃষ্ণা: টাইপ ১ ডায়াবেটিসের কারণে শরীরের তরলসমূহের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়, ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি বেশি বেশি তৃষ্ণা অনুভব করে।
ঘন ঘন
প্রস্রাব: এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর অতিরিক্ত গ্লুকোজ শরীর থেকে প্রস্রাবের
মাধ্যমে বেরিয়ে যেতে চায়, যার ফলে রোগী বারবার
প্রস্রাব করতে থাকে।
ওজন হ্রাস:
ইনসুলিনের অভাবে শরীর সঠিকভাবে গ্লুকোজ ব্যবহার করতে পারে না, যার ফলে শরীর নিজে থেকেই চর্বি ও পেশী টিস্যু ব্যবহার
শুরু করে, এতে আক্রান্ত ব্যক্তির দ্রুত ওজন কমতে থাকে।
অতিরিক্ত
ক্ষুধা: আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর যথাযথভাবে গ্লুকোজ শোষণ করতে না পারায় রোগী
সবসময় ক্ষুধার্ত অনুভব করতে পারে।
অস্বাভাবিক
ক্লান্তি বা দুর্বলতা: গ্লুকোজ থেকে পর্যাপ্ত শক্তি না পাওয়ার কারণে রোগী সবসময়
ক্লান্ত ও দুর্বল অনুভব করতে পারে।
দৃষ্টির
সমস্যা: রক্তে উচ্চ গ্লুকোজের মাত্রা চোখের লেন্সে প্রভাব ফেলতে পারে, যার ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হতে পারে।
শুষ্ক ত্বক ও
সংক্রমণ: টাইপ ১ ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তির ইনসুলিনের অভাবে ত্বক শুষ্ক হয়ে
যেতে পারে এবং বিভিন্ন সংক্রমণ, বিশেষ করে ত্বক ও
মূত্রনালীর সংক্রমণ বেশি হতে পারে।
রাতে
বাচ্চাদের বিছানা ভেজানো: রাতে বাচ্চাদের বিছানা ভেজানো বিশেষ করে যদি তারা আগে
থেকে বিছানা ভেজানো বন্ধ করে দিয়ে থাকে, এটি টাইপ ১
ডায়াবেটিসের একটি সম্ভাব্য লক্ষণ হতে পারে। টাইপ ১ ডায়াবেটিসের কারণে শরীরে
গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়, যা অতিরিক্ত
প্রস্রাবের সৃষ্টি করে। বাচ্চারা দিনে অনেক বেশি প্রস্রাব করতে থাকে এবং রাতে
ঘুমের সময়ও এই অতিরিক্ত প্রস্রাবের কারণে বিছানা ভেজাতে পারে।
মেজাজ
পরিবর্তন: মেজাজ পরিবর্তন টাইপ ১ ডায়াবেটিসের একটি সাধারণ লক্ষণ হতে পারে। রক্তে
শর্করার মাত্রা খুব বেশি বা খুব কম হলে মস্তিষ্কে এর প্রভাব পড়ে, যা মানসিক অবস্থার উপর প্রভাব ফেলে। এই কারণে
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে বারবার আচরণগত বা মানসিক পরিবর্তন লক্ষ্য
করা যায়।
টাইপ ১ ডায়াবেটিসের জটিলতা:
টাইপ ১
ডায়াবেটিসের কারণে রক্তে শর্করার মাত্রা দীর্ঘ সময় ধরে অস্বাভাবিকভাবে বেশি
থাকলে, এটি শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ও সিস্টেমের উপর
ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এই দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির ফলে বেশ কিছু গুরুতর জটিল রোগ ও
অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। এর মধ্যে প্রধান কিছু জটিলতা হলো:
কিডনির সমস্যা:
ডায়াবেটিসের
কারণে কিডনির ছোট ছোট রক্তনালীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার ফলে কিডনি
ধীরে ধীরে কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারে। এটির মাধ্যমে কিডনি ফেইলিউর হতে পারে, যার কারণে কিডনি ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হতে পারে।
চোখের সমস্যা:
রক্তে উচ্চ
শর্করা চোখের রেটিনার রক্তনালীগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, যার ফলে রেটিনোপ্যাথি হয়। এটি অন্ধত্বের কারণ হতে পারে।
এছাড়া ডায়াবেটিসে ক্যাটারাক্ট এবং গ্লুকোমার ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিতে পারে।
পায়ের সমস্যা:
টাইপ ১
ডায়াবেটিসের কারণে স্নায়ুতে ক্ষতি হতে পারে, বিশেষ করে
পায়ের স্নায়ুতে। এর ফলে পায়ে অসংবেদনশীলতা, ঝিনঝিন ভাব, এবং ব্যথা হতে পারে। পায়ে ক্ষত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়
এবং এটি যথাযথভাবে চিকিৎসা না করলে অঙ্গচ্ছেদ এর দরকার পড়তে পারে।
হৃদরোগ ও স্ট্রোক:
ডায়াবেটিস
ধমনীতে ফ্যাট জমার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে, যা
অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস সৃষ্টি করে। এর ফলে হৃদরোগ, হার্ট অ্যাটাক, এবং স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
কোমা বা মৃত্যু:
টাইপ ১
ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে ডায়াবেটিক কেটোঅ্যাসিডোসিসের সৃষ্টি করতে পারে। এটি
একটি তীব্র ও প্রাণঘাতী অবস্থা। শরীরে ইনসুলিনের অভাবে, গ্লুকোজ ব্যবহার না করে শরীর চর্বি ভাঙতে শুরু করে, যার ফলে কেটোন নামে এক ধরনের অ্যাসিড শরীরে জমা হয়। এটি
যদি দ্রুত চিকিৎসা করা না হয়, তাহলে কোমা বা মৃত্যুর
ঝুঁকি থাকে।
ডায়াবেটিক গ্যাস্ট্রোপ্যাথি:
টাইপ ১
ডায়াবেটিসের কারণে পাকস্থলীর স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গ্যাস্ট্রোপ্যাথি হতে পারে, যার ফলে খাবার হজমে সমস্যা, বমি, পেটে ব্যথা ইত্যাদি
হতে পারে।
ত্বকের সমস্যা:
ডায়াবেটিস
রোগীরা বিভিন্ন ত্বকের সংক্রমণ ও অন্যান্য ত্বকজনিত সমস্যার ঝুঁকিতে থাকে।
ব্যাকটেরিয়াল এবং ফাঙ্গাল ইনফেকশন ছাড়াও ত্বকে শুষ্কতা, খোসা ওঠা,
এবং ঘা দেখা
দিতে পারে।
টাইপ ১ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ:
দুর্ভাগ্যবশত, বর্তমানে টাইপ ১ ডায়াবেটিস প্রতিরোধের কোনো নির্দিষ্ট
উপায় নেই। এটি একটি অটোইমিউন রোগ, যেখানে শরীরের
প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভুলবশত অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষগুলোকে ধ্বংস করে
দেয়। এই প্রক্রিয়াটি কেন ঘটে, তা সম্পূর্ণভাবে এখনও
বোঝা যায়নি। যদিও কিছু জেনেটিক ও পরিবেশগত কারণ এর সাথে সম্পর্কিত বলে ধারণা করা
হয়, তবে এখন পর্যন্ত টাইপ ১ ডায়াবেটিস
প্রতিরোধের কোনো নিশ্চিত উপায় আবিষ্কৃত হয়নি।
কোন মন্তব্য নেই