Header Ads

টাইফয়েডের জটিলতা কী? ইহার কারণ এবং প্রতিকারের উপায়

টাইফয়েড জ্বর একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ যা ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে হয়। এটি সাধারণত দূষিত পানি বা খাবারের মাধ্যমে ছড়ায় এবং মানবদেহে বিস্তার ঘটায়। এটি মানব দেহকে খুবই দূর্বল করে ফেলে। ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধির মাধ্যমে টাইফয়েডের বৃদ্ধি ঘটে। আজকের এই আলোচনায় আমরা টাইফয়েড এর বিস্তারিত ব্যাখা নিয়ে আলোচনা করবো।

টাইফয়েড কী? 

টাইফয়েড (Typhoid) হলো একটি সংক্রামক ব্যাধি যা Salmonella typhi নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের ফলে হয়। এটি সাধারণত দূষিত পানি বা খাবারের মাধ্যমে ছড়ায় এবং মানবদেহে প্রবেশ করে রক্তপ্রবাহে সংক্রমণ ঘটায়। টাইফয়েড জ্বর মূলত অন্ত্র ও লিভারকে প্রভাবিত করে এবং সঠিক চিকিৎসা না হলে এটি জীবনঘাতী হতে পারে।


টাইফয়েডের লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর, মাথাব্যথা, দুর্বলতা, পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য, এবং কখনও কখনও শরীরে লালচে ফুসকুড়ি। টাইফয়েড জ্বরকে অবহেলা করলে এটি অন্ত্রে রক্তপাত বা অন্ত্রের ছিদ্রের মতো জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। এই রোগ প্রতিরোধের জন্য পরিষ্কার পানি ও খাবার গ্রহণ এবং টাইফয়েড টিকা নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

টাইফয়েড এর কারণ: 

টাইফয়েড জ্বরের প্রধান কারণ হলো Salmonella typhi নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ। এই ব্যাকটেরিয়া সাধারণত দূষিত পানি বা খাবারের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে। টাইফয়েডের সংক্রমণ হওয়ার কয়েকটি প্রধান কারণ নিচে দেওয়া হলো:

দূষিত পানি পান করা: 

দূষিত পানির মাধ্যমে টাইফয়েড জ্বর খুব সহজেই ছড়াতে পারে। যখন Salmonella typhi ব্যাকটেরিয়া মিশ্রিত পানি পান করা হয় বা সেই পানি দিয়ে রান্না করা খাবার খাওয়া হয়, তখন এই ব্যাকটেরিয়া মানবদেহে প্রবেশ করে এবং সংক্রমণ ঘটায়।

টাইফয়েড আক্রান্ত ব্যক্তির মল বা প্রস্রাব যদি পানির উৎসে মিশে যায় এবং সেই পানি সঠিকভাবে পরিশোধন না করা হয়, তবে ব্যাকটেরিয়া জীবিত থাকে এবং অন্যদের সংক্রমিত করতে পারে।

যদি জলাশয়গুলোতে দূষিত মল বা অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ মিশে যায়, তবে সেই পানি পান করলে বা রান্নার কাজে ব্যবহার করলে টাইফয়েডের সংক্রমণ হতে পারে। 

বন্যা বা ভারী বৃষ্টিপাতের সময়, মল-মূত্র এবং অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ সহজেই পানির উৎসের সাথে মিশে যায়, যা টাইফয়েড ছড়ানোর আশংকা বাড়ায়।

দূষিত খাবার গ্রহণ:

দূষিত খাবার গ্রহণের মাধ্যমে টাইফয়েড জ্বর খুব সহজেই ছড়াতে পারে। যদি খাবার সঠিক তাপমাত্রায় রান্না না করা হয়, তাহলে খাবারের মধ্যে থাকা ব্যাকটেরিয়া মারা যায় না, যা টাইফয়েডের সংক্রমণের কারণ হতে পারে।

রাস্তার খাবার বা স্ট্রিট ফুডের জন্য প্রায়ই বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করা হয় না এবং রান্নার পরিবেশ অপরিচ্ছন্ন থাকে। এই খাবারগুলো দূষিত ব্যাকটেরিয়া বহন করতে পারে। 

অনেক সময় ফল ও সবজি দূষিত পানি দিয়ে ধোয়া হয়, যা ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতির কারণ হতে পারে। বিশেষ করে যদি এগুলো খোসা ছাড়াই খাওয়া হয়, তাহলে টাইফয়েডের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

যদি খাবার প্রস্তুত করার আগে হাত ভালোভাবে পরিষ্কার না করা হয়, তাহলে খাবারের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া সহজেই ছড়াতে পারে। খাদ্য যদি সঠিক তাপমাত্রায় ফ্রিজে সংরক্ষণ না করা হয়, তাহলে ব্যাকটেরিয়া দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে এবং সংক্রমণ ঘটাতে পারে।

অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ:

যেসব জায়গায় আবর্জনা সঠিকভাবে ফেলা হয় না এবং যেখানে পানি জমে থাকে, সেসব জায়গায় ব্যাকটেরিয়া দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। এসব পরিবেশে খাবার ও পানির সংস্পর্শে এসে সহজেই ছড়াতে পারে।

অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে সাধারণত বিশুদ্ধ পানির অভাব থাকে, যা টাইফয়েড ছড়ানোর অন্যতম কারণ। দূষিত পানির ব্যবহারে ব্যাকটেরিয়া শরীরে প্রবেশ করতে পারে।

অপরিচ্ছন্ন স্থানে মাছি ও অন্যান্য পোকামাকড়ের উপস্থিতি বেড়ে যায়, যারা খাবার বা পানির সংস্পর্শে এসে ব্যাকটেরিয়া ছড়াতে সাহায্য করে।

মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ:

যদি টাইফয়েড আক্রান্ত ব্যক্তি টয়লেট ব্যবহারের পর হাত ভালোভাবে না ধুয়ে খাবার তৈরি করে বা অন্য কারও জন্য খাবার পরিবেশন করে, তাহলে সেই খাবারের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়তে পারে।

টাইফয়েড রোগী যদি সরাসরি স্পর্শের মাধ্যমে অন্য ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করে এবং উভয়ই পরিচ্ছন্নতার নিয়ম মেনে না চলে, তাহলে ব্যাকটেরিয়া সহজেই অন্য ব্যক্তির শরীরে প্রবেশ করতে পারে।

আক্রান্ত ব্যক্তি যদি খাবার বা পানির সংস্পর্শে আসে, তবে সেই খাবার বা পানির মাধ্যমেও অন্য লোকজন আক্রান্ত হতে পারে।

কিছু লোক টাইফয়েড আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হলেও তাদের শরীরে ব্যাকটেরিয়া জীবিত থেকে যায় এবং তারা অন্যদের সাথে মিলিত হওয়ার মাধ্যমে অন্যদের সংক্রমিত করতে পারে, যদিও তারা নিজেরা সংস্থ্য হয়ে গেছে।

টাইফয়েডের লক্ষণ সমূহ: 

টাইফয়েড জ্বরের লক্ষণগুলো সাধারণত ধীরে ধীরে শুরু হয় এবং সংক্রমণের ১-৩ সপ্তাহের মধ্যে প্রকাশ পায়। টাইফয়েডের প্রধান লক্ষণসমূহ নিম্নরূপ:

উচ্চ জ্বর: টাইফয়েডের প্রধান লক্ষণ হলো ক্রমশ বাড়তে থাকা জ্বর, যা ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠতে পারে।

মাথাব্যথা: তীব্র মাথাব্যথা হওয়া টাইফয়েড জ্বরের আরেকটি সাধারণ লক্ষণ।

দুর্বলতা এবং ক্লান্তি: শরীরে দুর্বলতা, ক্লান্তি এবং শক্তিহীনতা অনুভূত হতে পারে, যা দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটায়।

ক্ষুধামন্দা: খাবারের প্রতি অরুচি এবং ক্ষুধামন্দা দেখা দেয়।

পেটের ব্যথা: পেটের উপরের বা নিচের অংশে ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভূত হয়।

ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য: প্রাথমিকভাবে ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতে পারে, তবে প্রায়ই প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে কোষ্ঠকাঠিন্য এবং শিশুদের ক্ষেত্রে ডায়রিয়া দেখা যায়।

শরীরে লালচে র‍্যাশ: কিছু মানুষের শরীরে, বিশেষ করে বুকে এবং পিঠে, ছোট ছোট লালচে দাগ বা ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে।

শরীরের তাপমাত্রায় ওঠানামা: দিনের বেলা জ্বর একটু কমে যেতে পারে, আবার রাতে বেড়ে যায়।

বমি ভাব বা বমি: কিছু রোগীর বমি বমি ভাব বা মাঝে মাঝে বমি হতে পারে।

গোলাপী রংয়ের দানা: জ্বরের ২য় সপ্তাহে রোগীর পেটে ও পিঠে গোলাপি রঙের দানা দেখা যেতে পারে।

হার্টরেট কমে যাওয়া: টাইফয়েডের কারণে হার্ট রেট বা হৃদস্পন্দন অনেক কমে যেতে পারে।

টাইফয়েডের জটিলতা: 

টাইফয়েডের সঠিকভাবে এবং সময়মতো চিকিৎসা না হলে এটি গুরুতর জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। এই জটিলতাগুলো রোগীর জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে পারে। টাইফয়েডের প্রধান জটিলতাগুলো নিম্নরূপ:

অন্ত্রের রক্তপাত: টাইফয়েড জ্বরের সবচেয়ে সাধারণ এবং বিপজ্জনক জটিলতা হলো অন্ত্রের রক্তপাত। এটি সাধারণত সংক্রমণের তৃতীয় সপ্তাহে ঘটে এবং এটি অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের কারণ হতে পারে, যা খুব তীব্র আকার ধারণ করতে পারে।

অন্ত্রের ছিদ্র বা পারফোরেশন: অন্ত্রের ছিদ্র হওয়া আরেকটি মারাত্মক জটিলতা। এতে অন্ত্রের দেয়ালে ছিদ্র তৈরি হয়, যার ফলে অন্ত্রের উপাদান পেটের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ে এবং গুরুতর সংক্রমণ বা পেরিটোনাইটিস সৃষ্টি করতে পারে। এটি একটি জীবন-সংকটজনক অবস্থা যা জরুরিভাবে চিকিৎসার প্রয়োজন।

ডিহাইড্রেশন এবং ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা: দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়া এবং উচ্চ জ্বরের কারণে শরীরে পানিশূন্যতা এবং ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা হতে পারে, যা রোগীর শারীরিক অবস্থাকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।

মানসিক বিভ্রান্তি ও মস্তিষ্কে সংক্রমণ: টাইফয়েডের কারণে মস্তিষ্কে সংক্রমণ বা এনসেফালোপ্যাথি হতে পারে, যার ফলে রোগী বিভ্রান্তি, অস্বাভাবিক আচরণ, অচেতনতা, এমনকি কোমার মতো অবস্থায় পৌঁছে যেতে পারে।

হৃদরোগের জটিলতা: টাইফয়েড কখনো কখনো মায়োকার্ডাইটিস বা হৃদপেশীর প্রদাহ, এন্ডোকার্ডাইটিস বা হৃদযন্ত্রের অভ্যন্তরের স্তরের প্রদাহ, বা রক্তচাপ কমে যাওয়ার মতো সমস্যা তৈরি করতে পারে।

অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যকারিতা নষ্ট হওয়া: দীর্ঘস্থায়ী টাইফয়েড রোগে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, যেমন কিডনি বা লিভার, ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং সেগুলোর কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

টাইফয়েড ক্যারিয়ার স্টেট: কিছু মানুষ টাইফয়েডে আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হলেও তাদের শরীরে ব্যাকটেরিয়া দীর্ঘ সময় ধরে জীবিত থাকতে পারে। এদের "ক্যারিয়ার" বলা হয়, এবং তারা সুস্থ থাকলেও অন্যদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়াতে পারে।

টাইফয়েড প্রতিরোধের উপায়: 

কিছু সাধারন সতর্কতা মেনে চললে টাইফয়েডের সংক্রমণের ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। এই সতর্কতা গুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে জড়িত। নিম্নে সাধারন সতর্কতা গুলো তুলে ধরা হলো: 

•  সবসময় ফুটানো বা ফিল্টার করা পানি পান করতে হবে।

•  বোতলজাত পানি বা বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন পানি ব্যবহার করতে হবে।

•  সবসময় পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ পানি দিয়ে ধোয়া খাবার গ্রহণ করতে হবে।

•  খাবার সঠিক তাপমাত্রায় রান্না এবং সংরক্ষণ করতে হবে।

•  রাস্তার খাবার এড়িয়ে চলতে হবে, বিশেষ করে অপরিষ্কার পরিবেশে তৈরি খাবার।

•  পরিচ্ছন্ন ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

•  পরিষ্কার টয়লেট ব্যবহার করা এবং মল-মূত্র সঠিকভাবে নিষ্পত্তি করতে হবে।

•  সবসময় টয়লেট ব্যবহারের পরে এবং খাবার খাওয়ার আগে হাত ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে।

•  আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার পর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মেনে চলতে হবে।

•  খাবার ও পানিকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ এবং প্রস্তুত করতে হবে।

•  টাইফয়েড রোগীকে পৃথক করা এবং তাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র ভালোভাবে পরিষ্কার অবশ্য কর্তব্য।

টাইফয়েডের জটিলতা এড়াতে দ্রুত এবং সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ। রোগীর অবস্থা খারাপ হলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এবং উপযুক্ত চিকিৎসা গ্রহণ করা প্রয়োজন। টিকা গ্রহণ এবং পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা টাইফয়েড প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.