গ্লুটেন কী? গ্লুটেন যুক্ত খাবার ও ক্ষতিকর দিক সমূহ
আমাদের মধ্যে
অনেকেই আছেন যারা গ্লুটেন যুক্ত খাবার খেলেই বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভোগেন। তারা
গ্যাস, কোষ্ঠকাঠিন্য, পাতলা পায়খানা
বা এ্যালার্জিতে আক্রান্ত হন। আমাদের দৈনন্দিন বিভিন্ন খাবারের মধ্যে গ্লুটেন
রয়েছে। এই ধরনের খাবার সবার জন্য সমস্যা সৃষ্টি করে না, তবে যাদের এই খাবার প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তারা
বিভিন্ন সমস্যায় ভুগে থাকেন। আজকে আমরা জানবো গ্লুটেন কী এবং গ্লুটেন সমৃদ্ধ
খাবারের তালিকা ও শারীরিক সমস্যা গুলো সম্পর্কে।
গ্লুটেন কী?
গ্লুটেন (Gluten) হলো এক ধরনের প্রোটিন, যা সাধারণত গম, বার্লি, এবং রাইয়ের মতো শস্যে পাওয়া যায়। এটি মূলত দুটি প্রোটিনের মিশ্রণ: গ্লুটেনিন এবং গ্লিয়াডিন। গ্লুটেন খাদ্য প্রস্তুতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কারণ এটি আটা বা ময়দায় পানির সাথে মিশে একটি স্থিতিস্থাপক গঠন তৈরি করে, যা পাউরুটি, পাস্তা, কেক, চিপস, সস, ইত্যাদির সঠিক গঠন এবং বাউন্সি টেক্সচার নিশ্চিত করে।
গ্লুটেন সমৃদ্ধ খাবার কোন গুলো:
গ্লুটেন একটি
প্রোটিন। মূলত গম এবং গম থেকে উৎপন্ন খাবারে উচ্চমাত্রায় গ্লুটেন থাকে। এ ছাড়া যব, বার্লি, রাই ও সুজি দিয়ে তৈরি
খাবারেও গ্লুটেন পাওয়া যায়। গ্লুটেন সমৃদ্ধ অন্যান্য খাবারগুলির মধ্যে রয়েছে:
গ্লুটেন
সমৃদ্ধ শস্য:
· গম: গমের আটা, ময়দা, সেমোলিনা, স্পেল্ট, ডুরাম।
· বার্লি: জাউ।
· রাই: রাইয়ের
রুটি।
প্রক্রিয়াজাত
খাবার:
· রুটি ও
পাউরুটি: গমের আটা দ্বারা তৈরি করা রুটি ও পাউরুটি।
· পাস্তা: গমের
তৈরি পাস্তা, নুডলস।
· বিস্কুট ও
কুকিজ: প্রায় সব ধরনের বিস্কুটে গ্লুটেন থাকে।
· পাই ও
পেস্ট্রি: পেস্ট্রিতে উচ্চ মাত্রার গ্লুটেন থাকে।
· কেক ও মাফিন:
কেকে উচ্চ মাত্রার গ্লুটেন থাকে, যেটি অন্যান্য খাবারের
তুলনায় অনেকাংশে বেশি।
· সিরিয়াল:
অনেক প্রাতঃরাশের সিরিয়ালে গ্লুটেন থাকে।
· ক্র্যাকার ও
প্রেটজেল: মাঝারি আকারের গ্লুটেন সমৃদ্ধ খাবার এই দুটি।
অন্যান্য
প্রক্রিয়াজাত খাবার:
· সস ও ড্রেসিং:
অনেক সসে গ্লুটেনযুক্ত ঘনকারী এজেন্ট থাকে।
· সুপ ও সসের
মিশ্রণ: অনেক সসে গ্লুটেন থাকে।
· সয়া সস:
বেশিরভাগ সয়া সসে গ্লুটেন থাকে।
মদ ও বেভারেজ:
· বিয়ার:
বার্লি বা গম থেকে তৈরিতে উচ্চ মাত্রার গ্লুটেন থাকে।
· মাল্টেড মিল্ক
ড্রিঙ্কস: মাল্টেড মিল্কে গ্লুটেন যুক্ত থাকে।
গ্লুটেন
সমৃদ্ধ খাবার কী ধরনের সমস্যা তৈরি করে?
গ্লুটেন
সাধারণত বেশিরভাগ মানুষের জন্য নিরাপদ,
তবে কিছু
মানুষের জন্য এটি স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণ হতে পারে। গ্লুটেন-সম্পর্কিত
সমস্যাগুলো মূলত তিনটি প্রধান ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যায়:
একটি অটোইমিউন
রোগ যেখানে গ্লুটেন খেলে ইমিউন সিস্টেম আন্ত্রিক গাত্রকে আক্রমণ করে। এর ফলে খাবার
থেকে পুষ্টি শোষণে বাধা তৈরি হয় এবং দেখা দিতে পারে বিভিন্ন সমস্যা:
· পেট ব্যথা, ডায়রিয়া,
মারাত্নক
কোষ্ঠকাঠিন্য
· অনিয়মিত
পায়খানার অভ্যাস
· ওজন কমে
যাওয়া
· ক্লান্তি ও
অবসাদ
· আয়রন-ঘাটতি
অ্যানিমিয়া
· ত্বকে বিভিন্ন
ধরনের চর্ম রোগ
২.
নন-সিলিয়াক গ্লুটেন সেন্সিটিভিটি (Non-Celiac
Gluten Sensitivity):
এটি সিলিয়াক
ডিজিজ নয়, তবে গ্লুটেন খেলে কিছু
উপসর্গ দেখা দেয়। সাধারণত উপসর্গগুলো হলো:
· পেট ফাঁপা, গ্যাস
· মাথাব্যথা বা
মাইগ্রেন
· অবসাদ
· মানসিক
কুয়াশা
· ঘুমের ব্যাঘাত
· জয়েন্ট বা
পেশির ব্যথা
৩. গ্লুটেন
ইনটলারেন্স বা গ্লুটেন অ্যালার্জি:
এটি সরাসরি
অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, যেমন:
· ত্বকে র্যাশ
বা চুলকানি
· শ্বাসকষ্ট
· হাঁচি বা নাক
বন্ধ হয়ে যাওয়া
· পেটের ব্যথা, বমি, ও মারাত্নক
কোষ্ঠকাঠিন্য
অন্যান্য
সমস্যাগুলো:
কিছু লোকের মধ্যে গ্লুটেন খেলে ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম (IBS) এর উপসর্গ বাড়তে পারে। অটোইমিউন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের গ্লুটেন খেলে রোগের উপসর্গ বাড়ার ঝুঁকি থাকে।
শিশুদের উপর গ্লুটেনের প্রভাব:
উপরে বর্ণিত
সকল সমস্যা গুলো প্রাপ্ত বয়স্কদের পাশাপাশি শিশু-কিশোরেরাও সমান ভাবে আক্রান্ত হন।
তবে এই গুলো ছাড়াও শিশু-কিশোরেরা অতিরিক্ত কিছু সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে, যেমন:
পুষ্টির অভাব:
আন্ত্রিক গাত্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় শরীর ঠিকমতো পুষ্টি শোষণ করতে পারে না। ফলে
শিশুদের মধ্যে ওজন হ্রাস বা শারীরিক বৃদ্ধি বাধা প্রাপ্ত হতে পারে।
পেটের সমস্যা:
বারবার ডায়রিয়া, বমি, পেট ফাঁপা,
গ্যাস, মারাত্নক কোষ্ঠকাঠিন্য, অনিয়মিত
পায়খানা সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
আয়রন ঘাটতি:
দিন দিন শরীর থেকে রক্ত কমে যাওয়া এবং শারীরিক দুর্বলতা তৈরি করে।
বিকাশের
বিলম্ব: শিশুদের উচ্চতার বৃদ্ধি কম হয় বা মানসিক দক্ষতার বিলম্ব ঘটতে পারে।
খাবারের প্রতি
অনিহা: শিশু-কিশোরেরা গ্লুটেনের প্রভাবে খেতে চাই না। খাওয়ার প্রতি তাদের কোনও
ইচ্ছা বা চাহিদা থাকে না। তারা সর্বদা পেট ফাঁপা, গ্যাস ও
অনিয়মিত পায়খানা সমস্যার কারণে তাদের খাবারের উপর কোনও চাহিদা থাকে না।
বিরক্তি ও
মেজাজ পরিবর্তন: গ্লুটেনের প্রভাবে শিশু-কিশোরেরা সবকিছুতে বিরক্তি ও মেজাজ
পরিবর্তনের সমস্যায় ভুগে থাকে। তারা সর্বদা ছঠফট করে, ঘ্যানঘ্যান করে, কান্নাকাটি
করে, এবং কখন কি করবে তার সিদ্ধান্ত নিতে পারে
না।
চর্ম রোগ:
গ্লুটেন যুক্ত খাবার গ্রহণকারী শিশু-কিশোরেরা সর্বদা বিভিন্ন ধরনের চর্ম রোগে ভুগে
থাকে। তবে ডার্মাটাইটিস হারপেটিফর্মিস চর্ম রোগ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত করে থাকে।
গ্লুটেন সহ্য
করতে না পারা শিশুদের ক্ষেত্রে বোন ডেনসিটি কমে যায়, ডায়াবেটিস টাইপ ১, এবং অটোইমিউন
রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। স্কুলে তারা সঠিক ভাবে মনোযোগ দিতে পারে না এবং কোনও কিছু
দ্রুত শিখতে পারে না।
গ্লুটেন মুক্ত খাবার:
নিচে প্রাপ্ত
বয়স্ক ও শিশু-কিশোরদের উপযোগী কিছু গ্লুটেন মুক্ত খাবারের নাম প্রদান করা হলো, যেমন: চাল,
ভুট্টা, বাজরা, জোয়ার, কিনোয়া, চিয়া বীজ, তেপরি, মাছ, মাংস, ডিম, সকল প্রকার ডাল, দুধ, দই, চিজ, যে কোনও প্রকার তাজা ফল ও শাকসবজি, আলু, মিষ্টি আলু, কাসাভা, গাজর, শসা, টমেটো, পালং শাক,
চালের আটা, ভুট্টার আটা,
বাদামের আটা, ছোলার আটা, মুড়ি, চালের আটার রুটি, চালের আটার
তৈরি পিঠা, পানি, ফলের রস, চা, এবং কফি।
গ্লুটেন যারা
সহ্য করতে পারে না তাদের জন্য এটি একধরনের বীষ। যাদের গ্লুটেনে প্রতিক্রিয়া রয়েছে
তাদের সর্বদা এটিকে এড়িয়ে চলা উচিত। দীর্ঘদিন গ্লুটেন সমৃদ্ধ খাবার খেলে এটি
স্থায়ী ভাবে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের এই
জাতীয় খাবার থেকে দূরে রাখা প্রত্যেক অভিভাবকের কর্তব্য।
কোন মন্তব্য নেই