কিডনিতে পাথর হওয়ার লক্ষণ, কারণ সমূহ এবং প্রতিকার
কিডনি মানুষের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। অনেকে কিডনিতে পাথর পড়া সমস্যায় ভুগে থাকেন। মানুষের বিভিন্ন অসচেতনতা মূলক কাজের কারণে সাধারণত কিডনিতে পাথর পড়ে থাকে। কিডনিতে পাথর পড়ার পর শরীরে বিভিন্ন রকমের লক্ষণ ও সমস্যা দেখা দেয়। আজকের আলোচনায় আমরা কিডনিতে পাথর পড়া এবং এর বিভিন্ন সমস্যা ও চিকিৎসা নিয়ে বিস্তারিত জানবো।
কিডনির পাথর আসলে কী?
কিডনিতে পাথর (Kidney Stone) হলো কঠিন ও কঠোর পদার্থের ছোট ছোট টুকরো যা কিডনিতে জমাট বেঁধে তৈরি হয়। এটি সাধারণত বিভিন্ন খনিজ পদার্থ ও লবণ থেকে গঠিত হয়, যেমন ক্যালসিয়াম, অক্সালেট, ইউরিক অ্যাসিড ইত্যাদি। কিডনিতে পাথর তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়াটি নেফ্রোলিথিয়াসিস বা ইউরোলিথিয়াসিস নামে পরিচিত।
কিডনি পাথরের গঠন:
কিডনির পাথরের গঠন মূলত বিভিন্ন খনিজ পদার্থ এবং লবণের জমাট বাঁধা থেকে হয়। এগুলো প্রস্রাবে
দ্রবীভূত খনিজ পদার্থের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার কারণে কিডনিতে জমা হয় এবং শক্ত পাথরে পরিণত হয়। পাথরের গঠন বিভিন্ন ধরণের হতে পারে এবং এটি নির্ভর করে কোন খনিজ পদার্থ বেশি জমা হয়েছে তার উপর।
কিডনির পাথরের প্রকারভেদ
এবং গঠন:
কিডনির পাথরের কয়েকটি প্রকারভেদ এবং ভিন্ন গঠন প্রণালী রয়েছে। ভিন্ন গঠনের কারণে এই পাথর গুলো ভিন্ন ভিন্ন কারণে তৈরি হয়। নিচে এই পাথরের প্রকারভেদ ও গঠন বর্ণনা করা হলো।
ক্যালসিয়াম
অক্সালেট পাথর:
· এই গুলো সবচেয়ে সাধারণ পাথর।
· গঠিত হয় ক্যালসিয়াম
এবং অক্সালেট থেকে।
· অক্সালেট সমৃদ্ধ খাবার যেমন: পালং শাক, চকলেট, বাদাম বেশি খেলে এই ধরনের পাথরের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
ক্যালসিয়াম
ফসফেট পাথর:
· ক্যালসিয়াম
এবং ফসফেট লবণ থেকে গঠিত।
· মূত্রের
pH বেশি হলে এই পাথর তৈরি হয়।
· কিডনি সংক্রমণ বা হাইপারপ্যারাথাইরয়ডিজম থাকলে এই ধরনের পাথর হতে পারে।
ইউরিক অ্যাসিড পাথর:
· ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেশি হলে এই পাথর গঠিত হয়।
· উচ্চ প্রোটিনযুক্ত খাবার এবং ডিহাইড্রেশন
এই পাথর তৈরির কারণ।
· সাধারণত প্রস্রাবের pH কম হলে এই পাথর হয়।
স্ট্রুভাইট
পাথর:
· ম্যাগনেসিয়াম, অ্যামোনিয়া, এবং ফসফেট থেকে গঠিত হয় এই পাথর।
· এটি প্রস্রাবে সংক্রমণের
কারণে তৈরি হয়।
· এই ধরনের পাথর নারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।
সিস্টিন পাথর:
· বিরল ধরনের পাথর যা সিস্টিন নামক অ্যামিনো অ্যাসিডের অতিরিক্ত নির্গমনের কারণে গঠিত।
· এটি একটি বংশগত সমস্যা সিস্টিনুরিয়া থেকে সৃষ্ট পাথর।
কিডনিতে পাথর হওয়ার কারণ:
কিডনিতে পাথর হওয়ার কারণগুলো মূলত প্রস্রাবে খনিজ পদার্থের অতিরিক্ত উপস্থিতি এবং প্রস্রাবের ঘনত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত। নিচে সাধারণ কারণগুলো উল্লেখ করা হলো:
পানি কম পান করা:
পর্যাপ্ত পানি না পানে প্রস্রাব ঘন হয়ে যায়, ফলে খনিজ পদার্থ জমাট বাঁধে এবং পাথর তৈরি হয়। যারা দিনে অন্তত ২ থেকে ৩ লিটার পানি পান না করেন তাদের কিডনিতে পাথর হওয়ার আশংকা বৃদ্ধি পায়।
খাদ্যাভ্যাস:
বেশি সোডিয়াম বা লবণ খেলে প্রস্রাবে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বেড়ে যায়, যার ফলে পাথর হতে পারে। অক্সালেটসমৃদ্ধ খাবার যেমন পালং শাক, চকলেট, বাদাম, বিট ইত্যাদি বেশি খেলে অক্সালেট পাথরের ঝুঁকি বেড়ে যায়। উচ্চ প্রোটিনযুক্ত খাবার খেলে কিডনিতে পাথর হতে পারে। বেশি প্রোটিন ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়ায়। প্রয়োজনের
বাইরে বেশি ক্যালসিয়াম
গ্রহণ করলে কিডনিতে ক্যালসিয়াম পাথর তৈরি হতে পারে।
পানিশূন্যতা:
পর্যাপ্ত পানি পান না করা, গরম আবহাওয়ায়
বা অতিরিক্ত ঘামের কারণে শরীরে পানিশূন্যতা তৈরি হলে পাথর হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
জিনগত কারণ:
পারিবারিক
ইতিহাস থাকলে কিডনিতে পাথরের ঝুঁকি বেড়ে যায়। পরিবারের কারও যদি কিডনিতে পাথর হওয়ার ইতিহাস থাকে তবে পরিবারের অন্যদেরও পাথর হওয়ার আশংকা থাকে।
প্রস্রাবের
pH পরিবর্তন:
প্রসাবে যদি pH এর মাত্রা কমে যায় তবে ইউরিক অ্যাসিড পাথরের ঝুঁকি বাড়ায়। প্রসাবে যদি pH এর মাত্রা বেড়ে যায় তবে ক্যালসিয়াম
ফসফেট এবং স্ট্রুভাইট
পাথরের ঝুঁকি বাড়ায়।
স্বাস্থ্য
সমস্যা:
দীর্ঘমেয়াদী মূত্রনালী সংক্রমণ স্ট্রুভাইট
পাথরের কারণ হতে পারে। স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজনের কারণে কিডনিতে অতিরিক্ত চাপ ফেলে এবং প্রস্রাবের
রাসায়নিক ভারসাম্য নষ্ট করে, যার ফলে কিডনিতে পাথর হতে পারে।
কিছু ওষুধের প্রভাব:
ডায়ুরেটিকস,
অ্যান্টাসিড, এবং কিছু কেমোথেরাপি ওষুধ দীর্ঘ সময় ধরে গ্রহণ করলে পাথর তৈরির ঝুঁকি বাড়তে পারে।
শারীরিক কার্যকলাপের অভাব:
দীর্ঘ সময় বসে থাকার ফলে ক্যালসিয়াম প্রস্রাবে
জমা হতে পারে, যা পাথর তৈরির ঝুঁকি বাড়ায়। নিয়মিত হাটা-চলা না করলে বা ব্যায়াম না করলে কিডনিতে পাথর জমা হতে পারে।
কিডনিতে পাথর হওয়ার লক্ষণ:
কিডনিতে পাথর হলে বিভিন্ন ধরণের লক্ষণ দেখা দিতে পারে, যা পাথরের আকার, অবস্থান এবং প্রস্রাবের
প্রবাহে বাধার উপর নির্ভর করে। কিছুক্ষেত্রে, ছোট পাথর কোনো লক্ষণ সৃষ্টি না করেও প্রস্রাবের সঙ্গে বের হয়ে যেতে পারে। তবে বড় পাথর হলে সাধারণত নিচের লক্ষণগুলো দেখা যায়:
তীব্র ব্যথা:
· পিঠের নিচের অংশ, কোমর, বা পাশের অংশে তীব্র ব্যথা হয়।
· ব্যথা কোমর থেকে তলপেট বা কুঁচকির দিকে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
· ব্যথা সাধারণত আকস্মিক শুরু হয় এবং নিয়মিত আসা-যাওয়া করতে পারে।
প্রস্রাবে
সমস্যা:
· প্রস্রাব করার সময় সামান্য বা তীব্র ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
· ঘন ঘন প্রস্রাবের
চাপ হতে পারে বা প্রস্রাবের
প্রবাহ কমে যেতে পারে।
· প্রস্রাব আটকে যাওয়া বা প্রসাব পুরোপুরি বের হতে সমস্যা হতে পারে।
প্রস্রাবের
রঙ পরিবর্তন:
· প্রস্রাবের
সাথে রক্ত যেতে পারে, যার ফলে প্রসাবের রং লালচে বা গোলাপি রঙ্গের হতে পারে।
· প্রস্রাবের
রঙ মেঘলা এবং প্রসাব দুর্গন্ধযুক্ত হতে পারে।
বমি ও বমি বমি ভাব:
· তীব্র ব্যথার কারণে বমি বা বমি বমি ভাব হতে পারে।
· মাঝে মাঝে বমিও হতে পারে।
জ্বর ও কাঁপুনি:
· কিডনিতে সংক্রমণ হলে জ্বর এবং কাঁপুনি দেখা দিতে পারে।
· এই লক্ষণটি সাধারণত স্ট্রুভাইট পাথরের ক্ষেত্রে বেশি হয়।
মূত্রনালীর
সংক্রমণের লক্ষণ:
· প্রস্রাব করার সময় জ্বালা বা পোড়া অনুভব হতে পারে।
· ঘন ঘন প্রস্রাবের
প্রয়োজন হতে পারে এবং প্রসাব ধীরে ধীরে বের হতে পারে।
কিডনি পাথরের চিকিৎসা:
কিডনির পাথর অপসারণের পদ্ধতি নির্ভর করে পাথরের আকার, অবস্থান, গঠন এবং রোগীর শারীরিক অবস্থার ওপর। চিকিৎসক রোগীর অবস্থা মূল্যায়ন
করে সঠিক পদ্ধতি নির্ধারণ করেন। নিচে কিডনির পাথর অপসারণের সাধারণ পদ্ধতিগুলো
তুলে ধরা হলো:
পানি পান: প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি (প্রায় ৮-১২ গ্লাস) পান করলে ছোট পাথর প্রাকৃতিকভাবে প্রস্রাবের
মাধ্যমে বের হয়ে যেতে পারে।
ব্যথানাশক
ওষুধ: পাথর নির্গমনের
সময় ব্যথা কমানোর জন্য ওষুধ দেওয়া যেতে পারে।
অ্যালফা-ব্লকার ওষুধ: মূত্রনালীর পেশি শিথিল করে প্রস্রাবের প্রবাহ সহজ করতে ব্যবহৃত হয়।
ইউরিক অ্যাসিড পাথরের জন্য: আলকালাইজিং
এজেন্ট যেমন পটাশিয়াম
সাইট্রেট ব্যবহার করা হয়, যা প্রস্রাবের pH বৃদ্ধি করে পাথর গলাতে সাহায্য করে।
শক ওয়েভ: উচ্চ-তরঙ্গ শক ওয়েভ ব্যবহার করে পাথর ছোট ছোট টুকরোতে ভেঙে ফেলা হয়, যা প্রস্রাবের
মাধ্যমে বের হয়ে যায়।
ইউরেটেরোস্কোপি: একটি ক্ষুদ্র ইউরেটেরোস্কোপ মূত্রনালী দিয়ে প্রবেশ করিয়ে পাথর সরাসরি দেখা ও অপসারণ করা হয়।
পারকুটেনিয়াস নেফ্রোলিথোট্রিপসি: পিঠে একটি ছোট ছিদ্র তৈরি করে বিশেষ সরঞ্জাম দিয়ে বড় আকারের পাথর অপসারণ করা হয়।
কিডনিতে পাথর প্রতিরোধ করার উপায়:
কিডনিতে পাথর প্রতিরোধ করার জন্য সঠিক জীবনযাপন এবং খাদ্যাভ্যাস
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিচে কিছু কার্যকর প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ দেওয়া হলো:
· প্রতিদিন অন্তত ৮-১২ গ্লাস পানি পান করা উচিত।
· প্রস্রাবের
রঙ হালকা হলুদ বা স্বচ্ছ রাখা লক্ষ্য করুন, যা যথেষ্ট হাইড্রেশনের
লক্ষণ।
· অতিরিক্ত লবণ খাওয়া কমান। দিনে ১ চা চামচের বেশি লবণ এড়িয়ে চলুন।
· পালংশাক, বিট, চকলেট, বাদাম, চা ইত্যাদি অক্সালেট সমৃদ্ধ খাবার পরিমিত পরিমাণে খান।
· খাদ্য থেকে পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম গ্রহণ করুন, তবে অতিরিক্ত সাপ্লিমেন্ট
এড়িয়ে চলুন।
· উচ্চমাত্রার
প্রাণীজ প্রোটিন কম খান, কারণ এটি ইউরিক অ্যাসিড পাথরের ঝুঁকি বাড়ায়।
· ফলমূল ও শাকসবজি বেশি খান যা প্রস্রাবের
অম্লতা কমায়।
· নিয়মিত ব্যায়াম করুন এবং প্রতিদিন অন্তত ২০ থেকে ২৫ মিনিট হাটুন।
· নিজের উচ্চতা অনুযায়ী ওজন ঠিক রাখুন।
· যাদের পাথরের পুনরাবৃত্তির ইতিহাস আছে, তারা প্রয়োজনীয় ওষুধ ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী গ্রহণ করুন।
· সোডা এবং চিনিযুক্ত
পানীয় কিডনির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, তাই এগুলো কম পান করুন।
কিডনিতে পাথর প্রতিরোধের
জন্য নিয়মিত পানি পান, সুষম খাদ্যাভ্যাস এবং সুস্থ জীবনযাপন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি কোনো সমস্যা বা উপসর্গ দেখা দেয়, দ্রুত ডাক্তারের
পরামর্শ নিন।
কোন মন্তব্য নেই