দাঁদ কী? প্রধান কারণ, দাঁদের লক্ষণ এবং চিকিৎসা
আমাদের মানব
শরীরে বিভিন্ন ধরনের চর্ম রোগ হয়ে থাকে। চর্ম রোগ গুলো অধিকাংশ সময়ে সংক্রামক হয়ে
থাকে। এই ধরনের রোগ গুলো প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা না করলে এটি পরবর্তীতে জটিল
আকার ধারন করতে পারে। বিভিন্ন রকমের চর্ম রোগের মধ্যে দাঁদ অন্যতম। আজকে আমরা দাঁদ
সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
দাঁদ কী:
দাঁদ (Ringworm) হলো একটি ছত্রাকজনিত চর্মরোগ, যা ডার্মাটোফাইট (Dermatophyte) নামক ফাঙ্গাস দ্বারা সৃষ্ট। এটি কোনো কীট বা পোকামাকড়ের সংক্রমণ নয়, বরং এক ধরনের ফাঙ্গাল সংক্রমণ। এটি গোলাকার বা রিং আকৃতির লালচে দাগ তৈরি করে বলে একে "Ringworm" বলা হয়, যদিও এর সঙ্গে কোনো কীটের সম্পর্ক নেই। এটি সাধারণত ত্বক, মাথার তালু এবং নখে দেখা যায়। দাঁদ সংক্রামক এবং এটি একজনের কাছ থেকে অন্যজনের কাছে সহজেই ছড়াতে পারে।
দাঁদ সংক্রমণের স্থান সমূহ:
দাঁদ হলো একটি
ছত্রাকজনিত চর্মরোগ যা ত্বক, চুল এবং নখে সংক্রমণ
সৃষ্টি করে। দাঁদ সংক্রমণ সাধারণত শরীরের বিভিন্ন স্থানে দেখা যেতে পারে, যেমন:
মাথার ত্বক (Scalp):
মাথার ত্বকের
দাঁদ Tinea Capitis নামে পরিচিত। এটির
জন্য চুল পড়া, ফোলাভাব, এবং খুশকির মতো লক্ষণ দেখা যায়।
দেহের ত্বক (Body):
দেহের ত্বকের
দাঁদ Tinea Corporis নামে পরিচিত। এটি
দেখতে গোলাকার বা আংটির মতো লালচে দাগের মতো হয়।
পায়ের ত্বক (Feet):
পায়ের ত্বকের
দাঁদ Tinea Pedis বা Athlete’s Foot নামে পরিচিত। এটি পায়ের আঙুলের ফাঁকে
চুলকানি, ফাটল, এবং
জ্বালাপোড়ার সৃষ্টি করে। বেশি সময় পানির কাজ করলে এটি আঙ্গলের ফাঁকে হয়ে থাকে, যাকে সাধারণত পা বা আঙ্গুল খেয়ে যাওয়া বলে।
কুঁচকি বা
উরুর সংলগ্ন অংশ (Groin Area):
কুঁচকি বা
উরুর সংলগ্ন অংশের দাঁদ Tinea
Cruris বা Jock Itch নামে পরিচিত। এটি উরুর সংলগ্ন অঞ্চলে লালচে
দাগ, চুলকানি ও ফোলা সৃষ্টি করে।
নখ (Nails):
নখে দাদেঁর
সংক্রমণকে Tinea Unguium বা Onychomycosis বলে। এটি নখের রং পরিবর্তন করে দেয় এবং নখ
অধিকাংশ সময়ে ঘন এবং দুর্বল হয়ে যায়।
হাতের ত্বক (Hands):
হাতের ত্বকের
দাঁদ Tinea Manuum নামে পরিচিত। এটি
হাতের তালুতে শুষ্কতা, ফাটল এবং লালচে দাগ
তৈরি করে।
দাঁদ হওয়ার কারণ সমূহ:
দাঁদ হওয়ার
প্রধান কারণ হলো ছত্রাক সংক্রমণ। এটি Dermatophytes
নামে পরিচিত
একধরনের ছত্রাকের কারণে হয়, যা ত্বকের কেরাটিন
ত্বক, চুল, এবং নখের
প্রোটিন) খেয়ে বেঁচে থাকে। নিচে দাঁদ হওয়ার সম্ভাব্য কারণসমূহ উল্লেখ করা হলো:
ছত্রাক সংক্রমণের উৎস:
মানুষ থেকে
মানুষে সংক্রমণ:কোনও ব্যক্তি দাঁদে আক্রান্ত হলে
আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে সরাসরি ত্বকের সংস্পর্শে এলে অন্যেরও দাঁদ হতে
পারে।
পোষা প্রাণী
থেকে: কুকুর, বিড়াল, গরু, ঘোড়া ইত্যাদি
সংক্রামিত প্রাণীর গায়ে হাত দিলে প্রাণী থেকে নিজের শরীরে দাঁদ হতে পারে।
পরিবেশ থেকে:
সংক্রমিত মাটি বা আর্দ্র পরিবেশে কাজ করলে তার থেকে শরীরে দাঁদ হওয়ার আশংকা থাকে।
ব্যক্তিগত অভ্যাস:
অপরিষ্কার পোশাক
বা তোয়ালে ব্যবহার: ছত্রাক সহজে আর্দ্র পরিবেশে বৃদ্ধি পায়। পরিধেয় পোশাক বা
তোয়ালে আর্দ্র থাকলে এবং অপরিস্কার থাকলে দাঁদ হতে পারে।
অন্যের
ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ব্যবহার: কোনও ব্যক্তি যদি দাঁদে আক্রান্ত হয় তার ব্যক্তিগত
জিনিস যেমন চিরুনি, ব্রাশ, টুপি বা জুতা ব্যবহার করলে দাঁদ হতে পারে।
খারাপ
ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি: নিয়মিত গোসল না করা বা ভেজা কাপড় দীর্ঘক্ষণ পরে থাকলে
দাঁদ হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। দাঁদ হওয়ার পর দীর্ঘক্ষণ ভেজা কাপড় পড়ে থাকলে দাঁদের
সংক্রমণ বহুগুন বৃদ্ধি পায় এবং সমস্ত শরীরে বিস্তার লাভ করতে থাকে।
পরিবেশগত কারণ:
আর্দ্র ও
স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ: ছত্রাক এমন স্থানে দ্রুত বৃদ্ধি পায় যেখানে আর্দ্রতা বেশি
থাকে। সুতরাং আর্দ্র ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করলে দাঁদ হওয়ার
আশংকা থাকে।
গরম ও
ঘর্মাক্ত ত্বক: ঘাম বেশি হলে বা ত্বক দীর্ঘক্ষণ ভেজা থাকলে দাঁদ সংক্রমণের ঝুঁকি
বাড়ে।
প্রতিরোধ ক্ষমতার ঘাটতি:
দুর্বল রোগ
প্রতিরোধ ক্ষমতা: শিশু, বয়স্ক এবং যাদের রোগ
প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, যেমন ডায়াবেটিস বা
এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে দাঁদ সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি।
অপুষ্টি বা
অনিদ্রা: শরীরের সাধারণ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে ছত্রাক সহজে সংক্রমণ ঘটাতে পারে।
কেউ অপুষ্টিতে ভুগলে কিংবা নিয়মিত না ঘুমালে দাঁদ হওয়ার আশংকা বৃদ্ধি পায়।
পেশাগত ঝুঁকি:
বিভিন্ন পেশা:
কৃষক, পশুপালক, এবং
খেলোয়াড়দের মধ্যে দাঁদের ঝুঁকি বেশি থাকে, কারণ তারা
মাটি বা সংক্রামিত প্রাণীর সংস্পর্শে বেশি থাকেন।
সাঁতারুদের
মধ্যে: নিয়মিত পানিতে থাকার কারণে আর্দ্র পরিবেশে পেয়ে সাঁতারুদের মধ্যে দাঁদ
হওয়ার আশংকা বেশি থাকে।
দাঁদ এর প্রধান লক্ষণ সমূহ:
দাঁদ এর
প্রধান লক্ষণগুলি ত্বকে ভীষণভাবে লক্ষ্য করা যায় এবং এগুলো সাধারণত স্যাঁতসেঁতে বা
গরম ত্বকে খুব বেশি দেখা দেয়। দাঁদের প্রধান লক্ষণগুলি হল:
গোলাকার বা
রিং আকৃতির দাগ:
· দাঁদ সাধারণত
গোলাকার বা রিং আকৃতির দাগ তৈরি করে।
· দাগের
কেন্দ্রে ত্বক পরিষ্কার থাকে, তবে চারপাশে লালচে, খসখসে বা ফাটা অংশ দেখা যায়।
· দাগের পরিসীমা
পরিষ্কারভাবে সীমাবদ্ধ থাকে, আর মাঝে মাঝে সীমানায়
ছোট ছোট ফোলা হতে পারে।
চুলকানি এবং
জ্বালাপোড়া:
· দাঁদ আক্রান্ত
স্থানে তীব্র চুলকানি এবং জ্বালা হতে পারে।
· আক্রান্ত
স্থানে স্নায়ুর উপর চাপ পড়ার কারণে এই উপসর্গ দেখা দেয়।
ত্বক শুষ্ক
এবং খসখসে হওয়া:
· দাঁদ আক্রান্ত
ত্বক শুষ্ক হয়ে যায় এবং ফেটে যেতে পারে।
· কখনও কখনও, দাগের উপরের অংশে সাদা বা সিলভারের মতো শুষ্ক ত্বক দেখা
যায়।
চুলের সমস্যা:
· মাথার দাঁদ
হলে চুল পড়া, চুলের গুঁড়া এবং মাথায়
শুষ্কতা দেখা দেয়।
· আক্রান্ত
স্থানে চুল দ্রুত ভেঙে পড়তে পারে এবং ত্বক খোসা ছাড়াতে পারে।
স্ফীত বা ফোলা অংশ:
· দাগের চারপাশে
কখনও কখনও হালকা স্ফীত বা ফোলা হতে পারে।
· আক্রান্ত
জায়গা তাপমাত্রা বাড়িয়ে যায় এবং ফোলাভাব দেখা দিতে পারে।
আক্রমণ
বিস্তার:
· দাঁদ একাধিক
স্থানে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এটি ত্বকে দ্রুত ছড়াতে পারে এবং একাধিক দাগ তৈরি করতে
পারে।
নখে সংক্রমণ:
· দাঁদ যদি নখে
সংক্রমিত হয়, তবে নখের রং বদলাতে
পারে। এটি হলদে বা সাদা হয়ে যেতে পারে এবং নখ মোটা, ভঙ্গুর বা
ভেঙে যেতে পারে।
দাঁদের চিকিৎসা:
দাঁদ একটি
ছত্রাকজনিত সংক্রমণ, এবং এটি সাধারণত
ফাঙ্গাল প্রতিরোধী ওষুধ দিয়ে সহজেই চিকিৎসা করা যায়। চিকিৎসা শুরু করার আগে, সঠিক ডায়াগনোসিস নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অন্য ধরনের ত্বক সমস্যার সাথে এটি মিলে যেতে পারে।
সাধারণত
প্রাথমিক পর্যায়ে ক্লোট্রিমাজোল, মাইকোনাজোল, টেরবিনাফিন বা কেটোকোনাজোল গ্রুপের Antifungal creams ব্যবহার করা হয়। এই ক্রিমগুলো আক্রান্ত
স্থানে দিনে এক বা দুইবার লাগাতে হয়। চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হয় যতক্ষণ না দাগ
পুরোপুরি শুকায়, সাধারণত ২-৪ সপ্তাহের
জন্য এটি লাগানোর দরকার পড়ে। পাউডার বা স্প্রে অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধও দাঁদের চিকিৎসায়
কার্যকরী হতে পারে। এগুলো সাধারণত ত্বক শুকনো রাখতে সহায়ক এবং ফাঙ্গাসকে প্রতিরোধ
করে।
যদি দাঁদ খুব
গুরুতর বা দীর্ঘস্থায়ী হয়, বা এটি অনেক স্থানে
ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে মুখে খাওয়ার
অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধ যেমন টেরবিনাফিন,
ফ্লুকোনাজোল
বা ইট্রাকোনাজোল দেওয়া হয়। এই ওষুধগুলি ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনের মাধ্যমে নিতে
হবে।
কিছু
প্রাকৃতিক উপায়েও আমরা দাঁদের চিকিৎসা করতে পারি। যেমন:
চা গাছের তেল
(Tea Tree Oil): এটি প্রাকৃতিক
অ্যান্টিফাঙ্গাল উপাদান হিসেবে কাজ করে। আক্রান্ত স্থানে এক বা দুই ফোঁটা লাগাতে
পারেন প্রতিদিন ২ থেকে ৩ বার করে।
লেবুর রস:
লেবুর রসেও অ্যান্টিফাঙ্গাল গুণ থাকে,
তবে কিছুটা
সতর্কতা প্রয়োজন কারণ এটি ত্বক জ্বালাতে পারে।
আপেল সিডার
ভিনেগারও কিছু ক্ষেত্রে উপকারী হতে পারে, তবে এটি
ব্যবহারের আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে দাঁদের চিকিৎসা সাধারণত অ্যান্টিফাঙ্গাল ক্রিম বা ওষুধ দিয়ে করা হয়, এবং চিকিৎসা শুরু করার পর নিয়মিত ও সঠিকভাবে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হয়। যদি কিছুদিনের মধ্যে কোনো উন্নতি না হয় বা সমস্যা বেড়ে যায়, তাহলে অবশ্যই একজন ডার্মাটোলজিস্ট বা ত্বক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
কোন মন্তব্য নেই